যশোর প্রতিনিধি:মহাসড়কে অসুস্থ প্রতিযোগিতা পিকনিকের বাসের দুর্ঘটনার কারণ বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।
দুর্ঘটনাকবলিত বাসটির চালক বারবার পিকনিকের অপর দুটি বাসের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছিলেন। আহত শিক্ষার্থী ও স্কুলের শিক্ষকরা এমন তথ্যই দিয়েছেন।
গত বৃহস্পতিবার রাতে যশোরের বাকড়ী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষাসফরের একটি বাস দুর্ঘটনাকবলিত হয়ে দু’জন নিহত ও অন্তত ৪০ জন আহত হন। শিক্ষা সফর শেষে টুঙ্গিপাড়া থেকে ফেরার পথে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলায় ওই দুর্ঘটনা ঘটে।
নিহতরা হলেন, বাকড়ী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য ও যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার বাকড়ী গ্রামের গকুল চন্দ্র বিশ্বাসের ছেলে বিদ্যুৎ বিশ্বাস (৫০) এবং বিদ্যালয়ের ল্যাব সহকারী সুদিপ্ত বিশ্বাস (৩০)। আহতরা সবাই যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার বাকড়ী বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদস্যবৃন্দ।
আহত শিক্ষার্থী অজয় ভৌমিক জানায়, ‘প্রথম থেকে বাসটি আগে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় মেতেছিলো। দুর্ঘটনায়কবলিত লাল রঙের আমাদের বাসটি কয়েকবার সবার শেষে থেকে সবার আগেও যায়। ওই সময় বাসের মধ্যে কেউ ঘুমাচ্ছিলো, কেউ বা গানের তালে তালে নাচছিলো। শেষবার আমাদের বাসটি সবার শেষে থেকেও প্রথম বাসটিকে ওভারটেক করতে যেয়ে বাস উল্টে সড়কের পাশে গাছের সঙ্গে মেরে দিলো। তারপর আমরা পড়ে গেছি। তারপর আমরা চিৎকার চেচামেচি শুরু করি। এরপর দেখি আমরা হাসপাতালের বিছানায়।’
ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের গোপালগঞ্জের ভাটিয়াপাড়ায় যশোরের বাঘারপাড়া বাকড়ী বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষাসফরের বাস দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া অজয় ভৌমিক শুক্রবার যশোর মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালের বেডে এভাবেই শ্বাসরুদ্ধকর বর্ণনা দিচ্ছিল। সে দুর্ঘটনা কবলিত ওই বাসের মাঝের দিকে থাকায় প্রাণে বেঁচে যায়। বেঁচে ফিরলেও অল্প বয়সে এতো বড়ো দুর্ঘটনার শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি সে।
গত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮ টার দিকে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের কাশিয়ানী উপজেলার ভাটিয়াপাড়ায় একটি শিক্ষাসফরের বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাছের সঙ্গে ধাক্কা লেগে দুজন নিহত হন। নিহতেরা হলেন বাকড়ী বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অভিভাবক সদস্য বিদ্যুৎ কুমার বিশ্বাস ও বিদ্যালয়ের ল্যাব সহকারী সুদিপ্ত বিশ্বাস। নিহতদের শুক্রবার সকালে ধর্মীয় আচার রীতি অনুয়ায়ী সৎকার সম্পন্ন হয়েছে।
এ ঘটনায় আহত হন আরও অন্তত ৪০ জন। আহতদের গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী স্বাস্থ্য কমপে¬ক্সে, ফরিদপুর ও যশোর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরবর্তীতে কয়েকজনের অবস্থা অবনতি হলে ঢাকা ও খুলনাতে রেফার করা হয়েছে।
বেঁচে ফিরে নবম শ্রেণির এই শিক্ষার্থী দুঃসহ ঘটনার ওই বর্ণনা দেয়। সে আরও জানায়, লাল রঙের বাসটিতে কোন মেয়ে ছিলো না। ৮, ৯ ও দশম শ্রেণির ছাত্র ও তিন থেকে চার জন স্যার ছিলেন। তার মধ্যে আমাদের বিদ্যালয়ের অভিভাবক সদস্য বিদ্যুৎ কুমার বিশ্বাস ও বিদ্যালয়ের ল্যাব সহকারী সুদীপ্ত বিশ্বাস স্যার বাসের প্রথম সিটে বসেছিলেন।
তার দুই ছিট পিছনে আমি আর আমার স্বপ্ন বিশ্বাস নামে এক বন্ধু ছিলো। স্বপ্ন ঘুমিয়ে ছিলো, আর আমি জেগে ছিলাম। দুর্ঘটনার আগে অনেক সুন্দর সময় কাটিয়েছি আমরা। আমার সামনের দু’জন মারা গেছে ভাগ্যক্রমে আমরা বেঁচে গেছি। দশম শ্রেণির ছাত্র অনিক বিশ্বাস বলেন, তিনটি বাসই পরপর যাচ্ছিলো। মাঝে মধ্যে একে অন্যের আগে পরে যাওযার প্রতিযোগিতা লক্ষ করেছি। দুর্ঘটনায় পড়ার পরে পিছনের বাস দুটিতে থাকা স্যারেরা আমাদের উদ্ধার করে। রক্তাক্ত অবস্থায় যশোর হাসপাতালে এনেছিলো শুনেছি।
আহতদের মধ্যে যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি ২৫ জন, গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী স্বাস্থ্য কমপে¬ক্সে ৩ জন আর খুলনা ও ঢাকাতে ৪ জন রয়েছে বলে বিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে।
দুর্ঘটনার পর ফায়ার সার্ভিস, কাশিয়ানী থানা পুলিশ ও হাইওয়ে পুলিশ আহতদের উদ্ধার করে কাশিয়ানী ১০০ শয্যা হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখান থেকে আহত ২০ জনকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ২০ জনকে যশোর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। আহতের মধ্যে বিদ্যালয়ের ল্যাব সহকারী সুদিপ্ত বিশ্বাসকে যশোর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান।
এদিকে দুর্ঘটনার খবর শুনে রাতেই আহত ও নিহতের খোঁজ খবর নিতে আসেন যশোরের জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খানসহ, প্রশাসন, বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন ও সামাজিক অঙ্গনের বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ হাসপাতালে ছুটে যান। একের পর এক এ্যাম্বুলেন্স আহত শিক্ষার্থীদের নিয়ে যশোর হাসপাতালে আসলে হাসপাতাল চত্বরে শোকাবহ পরিবেশের সৃষ্টি হয়। হাসপাতাল চত্বরে রোগীর স্বজনদের আহাজারিতে পরিবেশ ভারি হয়ে উঠে।
যশোর জেনারেল হাসপাতালে তত্ত্বাবধায়ক ডা. আখতারুজ্জামান বলেন, যশোরে চিকিৎসাধীন ২৫ জনের মধ্যে ৫ জনের অবস্থা গুরুতর। এর মধ্যে ১ জনকে আইসিইউতে ও বাকী চারজনকে ঢাকা ও খুলনাতে রেফার্ড করা হয়েছে। বাকীদের বেশি সমস্যা না।
আইসিইউতে থাকা আপন বিশ্বাসের মা ইরা বিশ্বাস বলেন, তার ছেলে নবম শ্রেণিতে পড়ে। বৃহস্পতিবার অনেক আনন্দ করে বন্ধুদের সাথে পিকনিকে যায়। ফেরার পথে দুর্ঘটনায় পড়ে। কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, তার দুই ছেলে মেয়ে। ছেলেটা ছোট বলে খুব আদরের ছিলো। সেই ছেলেটা এখন আইসিইউতে। আনন্দ করতে যেয়ে এখন বিষাদে পরিণত হয়েছে তার জীবন।
বাকড়ী বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মৃণাল কান্তি রায় বলেন, আহতদের সকলকে খোঁজ খবর নেওয়া হচ্ছে। এই দুর্ঘটনা কারোও কাম্য ছিলো না। সবাই দিনভর আনন্দ করেছিলাম। রাতে বিদ্যালয়ে ফেরার পথে একটি বাস আরেকটি বাসকে ওভারটেক করতে যেয়ে সড়কের ডান পাশের একটি গাছে আঘাত করে। এই ঘটনায় একজন সহকর্মী ও অভিভাবক সদস্য মারা গেছেন। আমরা এই ঘটনায় শেকাহত।
বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক বিশ্বজিৎ কুমার পাল বলেন, গত‘বৃহস্পতিবার সকালে তিনটি বাসে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিস্থলে শিক্ষাসফরে যায় দুই শতাধিক শিক্ষার্থী, শিক্ষক, বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদস্য ও অফিস স্টাফরা। সারা দিন গোপালগঞ্জের বিভিন্ন স্থান ঘুরে সন্ধ্যার পরে সমাধিস্থল থেকে শিক্ষার্থীদের নিয়ে বাস তিনটি ফেরার পথে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী ভাটিয়াপাড়া মোড়ে দ্বিতীয় বাসটি প্রথম বাসটিকে ওভারটেক করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়ে। এতে প্রধান সড়ক থেকে বাসটি উল্টে সড়কের পাশে গাছে ধাক্কা লাগে। এই ঘটনায় আমরা শোকাহত। বিদ্যালয়ও এই এলাকা জুড়েই শোকাহত।
জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান বলেন, ‘দুর্ঘটনাকবলিত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসায় কোনো অসুবিধা হবে না। চিকিৎসার যাবতীয় অর্থ ও সহযোগিতা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেওয়া হবে। এ ঘটনায় আমরা শোকাহত।