বিশেষ প্রতিনিধি: আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়াচ্ছে আওয়ামী লীগ। তাই জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সিটি নির্বাচন সর্বোচ্চ বিতর্কমুক্ত রাখতে চায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
দলটি চাইছে প্রার্থীর জনপ্রিয়তার ওপর ভর করে সিটি নির্বাচনের বৈতরণী পার হতে। এর উদ্দেশ্য, জাতীয় নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ না দেওয়া।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধি মনোনয়ন বোর্ডের একজন সদস্য বলেন, শনিবার (১৫ এপ্রিল) গণভবনে দলের স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধি মনোনয়ন বোর্ডের সভা অনুষ্ঠিত হবে। সেখানেই দলীয় প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করবে আওয়ামী লীগ।
সক্ষমতা, জনপ্রিয়তা, বিভিন্ন জরিপ দেখে তারা প্রার্থী চূড়ান্ত করবেন। তাদের মতে, বিএনপি সরাসরি ভোটে না এলেও ঘোমটা পরে নির্বাচনের মাঠে থাকবে।
ফলে জাতীয় নির্বাচনের আগে এ নির্বাচনকে বেশ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত দলের সিদ্ধান্ত মেনে সবাই দলীয় প্রার্থীর পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করবেন- এটাই প্রত্যাশা।
অন্যদিকে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। তাই সিটি নির্বাচনে বিতর্কিত কিছু হলে বিএনপি সুযোগ পাবে। সিটি নির্বাচন বিদেশিরাও পর্যবেক্ষণ করবেন বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। তারা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে সিটি নির্বাচন সরকারের জন্য পরীক্ষা।
এখানে কোনো বিতর্ক উঠলে নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে বিএনপিসহ বিভিন্ন দেশ প্রশ্ন তোলার সুযোগ পাবে। তাদের সেই সুযোগ দেওয়া হবে না। তাই যেকোনো মূল্যে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে চান তারা।
আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য মুহাম্মদ ফারুক খান বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হলে দেশের জন্য ক্ষতি, গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতি এবং আমাদের জন্যও ক্ষতি।
তাই আমরা সব সময় চেষ্টা করি, কোনো নির্বাচন নিয়ে যেন বিতর্ক সৃষ্টি না হয়।’ ভোট সুষ্ঠু হওয়ার জন্য নির্বাচন কমিশনও ব্যবস্থা নেবে বলে মনে করেন তিনি।
নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী আগামী ২৫ মে গাজীপুর, ১২ জুন খুলনা ও বরিশাল এবং ২১ জুন রাজশাহী ও সিলেট সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হবে।
এরই মধ্যে এসব সিটির মেয়র পদে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের কাছে গত রবিবার থেকে দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রি করেছে আওয়ামী লীগ। গত তিন দিনে ৩৪ জন মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন।
জানা গেছে, পাঁচ সিটি করপোরেশনের মধ্যে রাজশাহী ও খুলনায় মেয়র প্রার্থী চূড়ান্তই বলা যায়। বরিশাল ও সিলেটেও মোটামুটি ঠিক। কিন্তু গাজীপুরে এখনো ঠিক হয়নি।
ওই সূত্র বলেছে, রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী হিসেবে বর্তমান মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনকে সবুজ সংকেত দেওয়া হয়েছে।
রাজশাহী আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন,‘খায়রুজ্জামান লিটনকে সবুজ সংকেত দেওয়ার কথা শুনেছি। এ কারণে আমি মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করিনি। স্থানীয় আওয়ামী লীগে কোন্দল থাকলেও বিএনপির প্রার্থী না থাকলে বর্তমান মেয়র সহজে নির্বাচনী বৈতরণী পার হবেন বলে মনে করা হচ্ছে।’
জানা গেছে, খুলনা সিটি করপোরেশনেও মেয়র পদে তালুকদার আবদুল খালেকের ওপরই আবারও আস্থা রাখবে আওয়ামী লীগ।
স্থানীয় সূত্র জানায়, খুলনা-২ আসনের এমপি ও প্রধানমন্ত্রীর চাচাতো ভাই শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েল গত বছরই তালুকদার আবদুল খালেকের পক্ষে নেতাকর্মীদের কাজ করার অনুরোধ করেন।
এতে তার মনোনয়ন অনেকটা চূড়ান্ত বলে মনে করা হচ্ছে। এ ছাড়া তালুকদার খালেক ছাড়া খুলনার মেয়র পদে প্রার্থী হতে আগ্রহী আলোচিত কেউ মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেননি।
বরিশাল সিটি করপোরেশনের বর্তমান মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর বিরুদ্ধে স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি পক্ষ সক্রিয়।
চাচা আবুল খায়ের আবদুল্লাহও (খোকন সেরনিয়াবাত) মনোনয়ন ফরম নিয়েছেন। তবে বিশেষ বিবেচনায় শেষ পর্যন্ত সাদিক আবদুল্লাহ আবারও মনোনয়ন পাবেন বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও মনোনয়ন বোর্ডের এক সদস্য।
তিনি বলেন, আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর যে প্রভাব এখনো রয়েছে, তা থেকে বের হয়ে আরেকজনকে প্রার্থী করার সম্ভাবনা আপাতত দেখা যাচ্ছে না।
যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলেছেন, তাকে সিলেট সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে দলীয় মনোনয়নের সবুজ সংকেত দেওয়া হয়েছে।
তবে সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগ এর বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর একজন সদস্য বলেন, সিলেটে দুই থেকে তিনজন শক্ত প্রার্থী রয়েছেন। তাদের মধ্যে আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী এগিয়ে আছেন।
গাজীপুরে মেয়র প্রার্থী নির্ধারণে দল এখনো সমস্যায় আছে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের একাধিক নীতিনির্ধারণী নেতা।
তারা বলছেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে কটূক্তির কারণে জাহাঙ্গীর আলমকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। পরে দুর্নীতির তদন্তের কারণে মেয়র পদ থেকেও তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
দলের প্রভাবশালী এক নেতার কারণে আওয়ামী লীগ তার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করেছে। তিনি আবার দলীয় মনোনয়ন পেতে জোর তদবির করছেন। প্রভাবশালী ওই নেতাও তার পক্ষে দলীয় হাই কমান্ডের কাছে বলতে পারেন। তারপরও তিনি মনোনয়ন না-ও পেতে পারেন।
এক্ষেত্রে মনোনয়নের দৌড়ে এগিয়ে থাকবেন গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লা খান।
বিএনপি এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দিলেও নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলটির তিনজন নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন।
যদিও তাদের বহিষ্কার করেছে বিএনপি।
সিলেট, বরিশাল, খুলনা ও গাজীপুরেও সম্ভাব্য মেয়র প্রার্থী হিসেবে বিএনপির কয়েকজন নেতার নাম শোনা যাচ্ছে। তারা প্রার্থী হলে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়তে হতে পারে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি ঘোমটা পরে আসতে পারে। তিনি দাবি করেন, সিলেটের বর্তমান মেয়র ও বিএনপি নেতা আরিফুল হক চৌধুরী নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন। অন্যান্য সিটিতেও ঘোমটা পরা বিএনপির স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছে। এটা তাদের রাজনীতির আরেক ভণ্ডামি।
গাজীপুরে সর্বোচ্চ ১৭ জন দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী মাঠে আছেন। সিলেটে আছেন ১০ জন। আর বরিশাল সিটি নির্বাচনে সাতজন আওয়ামী লীগের ফরম কিনেছেন।
এবার রাজশাহীতে তিনজন, খুলনায় চারজন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চান। বিএনপি না আসার ঘোষণার মধ্যে সব মিলিয়ে এই পাঁচ সিটিতে ৪১ জন নৌকার জন্য মাঠে রয়েছেন।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, শেষ পর্যন্ত দুই বা তিন সিটিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী থাকার শঙ্কা রয়েছে। এছাড়া অভ্যন্তরীণ কোন্দলও ভাবাচ্ছে দলটিকে। ফলে ঘরের প্রতিদ্বন্দ্বী নিয়েই চিন্তায় আওয়ামী লীগ।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, বিএনপি মুখে বলছে নির্বাচনে আসবে না। কিন্তু তাদের অনেক প্রার্থী আছে, সেটা আমরা টের পাই। আওয়ামী লীগের বিপক্ষে দাঁড় করানোর জন্য বিএনপি একজনকে জোগাড় করবে।
বিএনপি আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীদের মাঠে থাকার ব্যাপারে মদদ দিচ্ছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিএনপি এ ধরনের চেষ্টা চালাতে পারে। কিন্তু তারা সফল হবে না।
জানা গেছে, এবারের নির্বাচনে বিএনপি না এলেও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের একাধিক ব্যক্তি নির্বাচনে অংশ নিতে দলের কাছে মনোনয়ন চাইছেন।
আওয়ামী লীগ ছাড়াও জাতীয় পার্টি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও সামাজিক সংগঠন আগুয়ান-৭১ এর পক্ষ থেকেও মেয়র প্রার্থীরা কাজ শুরু করেছেন মাঠে।