রহমত আরিফ ঠাকুরগাঁও: কোনো জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য, ভাষা, কৃষ্টি, সংগ্রাম ও সংস্কৃ তির নিদ র্শনের সংগ্রহশালার আরেক নাম জাদুঘর। কালের ধারাবাহি কতায় দেশ বিদে শে অনেক জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হলেও জাতির শ্রমজীবী মানুষের জীবন-জীবিকার ইতি হাস, ঐতিহ্য ও সংগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন স্থান পায়নি এসব জাদুঘরে।
তাই খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের জীবন, জীবিকা, সংগ্রামের ইতিহাস ও নিদর্শন সংর ক্ষণ করা হয়েছে একটি জাদুঘরে। নাম ‘লো কায়ন-জীবন বৈচিত্র্য জাদুঘর’।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার ঠাকুরগাঁও শহর থেকে খানিকটা দূরে পূর্ব আকচা গ্রামে গড়ে তোলা হয়েছে এই জাদুঘর। এর উদ্যোক্তা ডক্টর মুহম্মদ শহীদ উজ জামান।
তিনি একটি বেসরকারি সংস্থার নির্বাহী পরি চালক। এই জাদুঘরে রাজাদের বীরত্বের ইতিহাসের চেয়ে মানুষের শ্রম ঘামের বিনিম য়ে গড়ে তোলা সামগ্রীই স্থান পেয়েছে বেশি।
এখানে শ্রমজীবী মানুষের জীবনযাপনে ব্য বহৃত নানাসামগ্রী ও তাদের সংস্কৃতির নানা উপকরণের পাশাপাশি বাংলাদে শের মহান মুক্তিযুদ্ধের অনেক দুর্লভ নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যাবে।
লোকায়নের যাত্রা শুরু হয় ২০০৬ সালে ‘তৃণমূল লোকজ গ্যালারি’ স্থাপনের মধ্য দিয়ে।
এই গ্যালারিতে কৃষক-খামারি, কামার-কুমা র, জেলে-তাঁতি, দিনমজুর, খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের ব্যবহার্য সবকিছুর দেখা মিলবে।
এখানে কৃষকের লাঙল-জোয়াল, মই, ফলা, নিড়ানি, দা, কা স্তে, খুন্তি মাথাল, ধান রাখার ডুবি, কৃষকের খেতের ইঁদুর মা রার নানা রক মের ফাঁদ, গরুর গলায় বেঁধে দেওয়া ঘুগরা, মু খে দেওয়া টুনা পাওয়া যাবে।
এ জাদুঘরে গৃহস্থালি বিভিন্ন পণ্য যেমন ডাল ভাঙার জাঁতা, ঢেঁকি, ছাম-গাইন, হাতুড়ি, শাবল, কোদাল, কুঠার, কামারের হাপর, দড়ি পাকানোর ঢ্যারা, সেচের জোত, মাছ ধরার চাঁই, পলো, জাল, টোটা, খড়ম, বসার মোড়া, পিঁড়ি, হুঁকা, কুপি, হাতপাখাও যান্ত্রি ক নিয়ে সাজিয়ে রাখা হয়েছে।
বলতে গেলে পুরো বাংলা দেশের শ্রমজীবী মানুষের জীব নযাত্রাই তুলে ধরার চেষ্টা রয়ে ছে জাদুঘরটিতে।
শুধু শ্রমজীবী মানুষের জীবন-জীবিকা ও সংগ্রামের ইতিহাস উপস্থাপন নয়, এখানে একে একে গড়ে তোলো হয়েছে ‘মুক্তি যুদ্ধ গ্যালারি’।
এ জাদুঘরে ১৭৫৭ সালের পলাশী যুদ্ধ থে কে শুরু করে ১৯৭ ১ সালের মহান মুক্তি যুদ্ধেও আলোকচিত্র, পত্রপত্রিকায় প্রকা শিত বিভিন্ন সংবাদ প্রদর্শন করা হয়েছে।
এখানে রয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত বি ভিন্ন উপকরণ, রণাঙ্গনের ইতিহাস ও ছোট ছোট বোতলে দেশের বিভিন্ন বধ্যভূমির মাটি।
ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জীবনযাপন, সংস্কৃতি, বাসস্থান ও পো শাক, খাদ্যাভ্যাস, পেশা, উৎসব সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে র বিভিন্ন উপকরণে সমৃদ্ধ ‘সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী গ্যালারি’।
এই জাদুঘরে গড়ে তোলা হয়েছে ‘আঞ্চলিক ভাষা গ্যালারি’। এই গ্যালারিতে দেশের ৬৪ জেলার জন্য ৬৪টি সুইচ আছে।
যে জেলার সুইচ অন করা হয়, সেই জেলার আঞ্চলিক ভা ষার কথা শোনা যায়।
আঞ্চলিক ভাষা সংরক্ষণের জন্য এটি একটি অসাধারণ ও অনন্য উদ্যোগ।
এখানে রয়েছে ‘নদী গ্যালারি’। যেখানে কাচের বোতলে দেশে র বিভিন্ন অঞ্চলের মরা ও বিলুপ্তপ্রায় নদীর পানি সংরক্ষণ করা হয়েছে। সেখানে তুলে ধরা হয়েছে নদী ও জনজীবন, সংস্কৃতি, উৎসবের তথ্যের পাশাপাশি নানা উপকরণ।
এ ছাড়া মানুষের জীবন-জীবিকার সঙ্গে সম্পর্কিত বর্ষামঙ্গল, নবান্ন, পিঠা উৎসবের মতো নানা উৎসব এখানে উদ্যাপন করা হয় নিয়মিত।
সেসব উৎসবে স্থানীয় লোকনাট্য ধামেরগান, কবিগান, গীত, আদিবাসী গান-নাচ পরি বেশন করা হয়। উৎসবে যোগ দেও য়া অতি থিদের আপ্যায়ন করা হয় কলাপাতা ও মা টির তৈরি বাসনকোসনে।
প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খোলা থাকে এ জাদুঘর। গাছগাছালির ফাঁকে ফাঁ কে রয়েছে বসার জন্য বাঁশ দিয়ে তৈরি মাচা। চেয়ার ও টেবিল তৈরি করা হয়ে ছে নানা গাছের গুঁড়ি দিয়ে।
জাদুঘরে বেড়াতে আসা শিশুদের বিনো দনের জন্য স্থাপন করা হয়েছে দোলনা, চড়কি, ঢেঁকিসহ নানা ধরনের খেলনা।
শিক্ষার্থী জিনু আহম্মেদ বলেন, বিশ্বে অনেক জাদুঘর আছে।
কিন্তু সেগুলোতে খেটে খাওয়া মানুষের ইতিহাস পর্দার আড়া লে রাখা হয়েছে। এই দিক থেকে এই জাদুঘর খেটে খাওয়া মানু ষের জীবনযাপন ও সংগ্রামের ইতিহাস ও নিদর্শন তুলে ধরে প্রশংসনীয় কাজ করা হয়েছে।
জাদুঘরের উদ্যোক্তা ডাক্টার মুহম্মদ শহীদ উজ জামান বলে ন, লোকায়ন শব্দটি কোনো আভিধানিক শব্দ নয়।
লোকজ, সংস্কৃতি ও শ্রমজীবী মানুষের জী বন-জীবিকা ও সংগ্রামে ব্যবহৃত উপকর ণভিত্তিক ওই জাদুঘর যখন লোকমানুষের জন্য, তাই এর নামকরণ করা হয়েছে লোকায়ন।
তিনি আরো বলেন, দেশ-বিদেশের জাদুঘ রগুলোতে অন্ত রালে রয়ে গেছে শ্রমজীবী মানুষের জীবন-জীবিকা ও সংগ্রা মের কথা। সংগ্রামী সব মানুষের জীবনগাথা চিরজাগ্রত রাখতেই লোকায়নের এ প্রচেষ্টা।