প্রতিদ্বন্দ্বিতা না প্রতিহিংসার লড়াই?
সানাউল্লাহ সাগর
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সহিংসতা যেন এখন একটি দুঃখজনক নিয়তি। প্রতিবার নির্বাচন এলেই সহিংসতা, হামলা, প্রতিহিংসা ও দমনপীড়ন বেড়ে যায় আশঙ্কাজনকভাবে। যদিও সরকার পক্ষ নিয়মিতভাবে “গণতান্ত্রিক চর্চার অগ্রগতির” বুলি আওড়ায়, বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ উল্টো। এ অবস্থার সাম্প্রতিক ও উদ্বেগজনক উদাহরণ হলো, জুলাই বিপ্লবের নেতাদের উপর সংঘটিত হামলা।
গত ১২ জুলাই, গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার মোচড়া বাজারে জুলাই বিপ্লবের নেতাদের সংগঠন এনসিপি’র উদ্যোগে পথসভা আয়োজন করা হয়। কেন্দ্রীয় এবং স্থানীয় নেতাদের উপস্থিতিতে শুরু হয় সভা, যেখানে গণতন্ত্র, দুর্নীতিবিরোধী সংগ্রাম, এবং বিকল্প রাজনৈতিক চিন্তার আহ্বান জানানো হচ্ছিল। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের কর্মীদের একটি দল ঘটনাস্থলে এসে স্লোগান দিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি করে। এক পর্যায়ে তারা মঞ্চে হামলা চালায়, চেয়ার-টেবিল ভাঙচুর করে, বক্তাদের উপর শারীরিক আঘাতের চেষ্টা করে। প্রশাসন উপস্থিত থাকলেও হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কোনো দৃশ্যমান ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
গোপালগঞ্জ শুধু একটি প্রশাসনিক জেলা নয়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক মানচিত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। এ জেলার পরিচিতি মূলত শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মস্থান হিসেবে, যেখানে তাঁর সমাধিস্থলও অবস্থিত। এখানেই আওয়ামী লীগের সভানেত্রী এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পৈত্রিক নিবাস। এই পারিবারিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস গোপালগঞ্জকে একটি ‘আওয়ামী আদর্শিক দুর্গ’ হিসেবে গড়ে তুলেছে। যেখানে রাজনৈতিক আনুগত্য কেবল দলীয় সমর্থনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং তা হয়ে উঠেছে একপ্রকার অন্ধ বিশ্বাস ও অতি আবেগের প্রকাশ।
এই আবেগ অনেক সময় গোপালগঞ্জের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে যায়, যেখানে বিরোধী মতামত শুধু ভিন্নমত হিসেবে দেখা হয় না, বরং তা ‘অপমান’ ও ‘বিশ্বাসঘাতকতা’র শামিল মনে করা হয়। ফলে এখানে বিরোধী রাজনীতি কেবল প্রতিযোগিতার জায়গা পায় না; বরং প্রায়শই সহিংস প্রতিক্রিয়ার শিকার হয়। অতীতে এমন বহু ঘটনা ঘটেছে, যেখানে বিরোধী দলের সভা-সমাবেশে বাধা, কর্মীদের ওপর হামলা, এমনকি পুলিশ প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা পর্যন্ত প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি হয় যখন স্থানীয় প্রশাসনের নীরবতা বা গোপন প্রশ্রয় সহিংসতার পৃষ্ঠপোষকতায় পরিণত হয়। তখন তা কেবল একটি জেলার অভ্যন্তরীণ ইস্যু থাকে না, বরং জাতীয় রাজনীতির জন্য গভীর সংকেতবাহী হয়ে ওঠে। এতে করে বিরোধী দলগুলোর মধ্যে ‘ভয়ের সংস্কৃতি’ গড়ে ওঠে, যা গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য চরম হুমকিস্বরূপ।
গোপালগঞ্জের মতো জেলার রাজনীতি যদি সহিষ্ণুতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতার বদলে প্রতিহিংসা ও নিষেধাজ্ঞার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে, তবে তা পুরো দেশের জন্য একটি অশুভ বার্তা দেয়। কারণ, জাতীয় রাজনীতির প্রতিচ্ছবি স্থানীয় রাজনীতিতে যেমন প্রতিফলিত হয়, তেমনি স্থানীয় রাজনীতির ধরনও জাতীয় রাজনীতিকে প্রভাবিত করে।
জুলাই বিপ্লবের নেতাদের সংগঠন এনসিপি একটি নবীন, বিকল্প রাজনৈতিক উদ্যোগ, যা তরুণ নেতৃত্ব, স্বচ্ছ রাজনীতি ও বিকেন্দ্রীকরণের নীতিতে বিশ্বাস করে। তারা মূলধারার দলগুলোর ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির বাইরে এসে একটি অংশগ্রহণমূলক ও ন্যায়ভিত্তিক রাজনীতির পক্ষে কথা বলে। এই আদর্শিক অবস্থানই হয়তো গোপালগঞ্জের মতো ‘আওয়ামী প্রভাব নির্ভর’ এলাকায় হুমকি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এনসিপি হয়তো এখনো ভোট রাজনীতির ক্ষেত্রে বড় শক্তি নয়, কিন্তু তারা একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। এবং সেই বার্তাই যেন সহ্য করতে পারেনি গোপালগঞ্জের মতো আওয়ামী লীগের অনুসারীরা।
একটি গণতান্ত্রিক সমাজের মূল ভিত্তি হল মতের বহুত্ব এবং মতবিরোধের সহনশীলতা। বিরোধী দলের অস্তিত্ব এবং তাদের কার্যক্রমকে কেবল সহ্য করাই নয়, বরং তা সংরক্ষণ ও সুরক্ষা করাও রাষ্ট্র এবং শাসক দলের সাংবিধানিক ও নৈতিক দায়িত্ব। অথচ বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরেই একটি বিপরীত প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে- যেখানে বিরোধী মত মানেই ‘রাষ্ট্রবিরোধী’, বিরুদ্ধ মত মানেই ‘ষড়যন্ত্রকারী’। এই মনোভাব শুধুমাত্র রাজনৈতিক সংস্কৃতির দৈন্যই নয়, বরং তা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার শিকড়কেই ঝুঁকিতে ফেলে।
সম্প্রতি গোপালগঞ্জে এনসিপির নেতা-কর্মীদের ওপর সংঘটিত সহিংসতা এই জাতীয় প্রবণতারই এক নগ্ন প্রতিফলন। এটি কেবল একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং একটি দীর্ঘস্থায়ী মানসিক ও সাংগঠনিক সমস্যার প্রতিফলন, যেখানে বিরোধী কণ্ঠর জন্য কোনো জায়গা নেই। এই ঘটনায় স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠে, আজকের বাংলাদেশে কি রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা আদৌ আদর্শনির্ভর? নাকি এটি রূপ নিয়েছে নিছক প্রতিহিংসার এক কৌশলগত প্রয়োগে, যেখানে নৈতিক যুক্তি নয়, বরং শারীরিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শক্তিই একমাত্র অস্ত্র?
যদি রাজনীতি কেবলমাত্র ক্ষমতা ধরে রাখার এবং ভিন্নমত দমন করার মাধ্যমে চলে, তাহলে গণতন্ত্র শুধুমাত্র একটি নির্বাচনী আয়োজনের নাম হয়ে পড়ে, যার মধ্যে অন্তঃসারশূন্যতা ছাড়া কিছু থাকে না। গোপালগঞ্জের মতো এলাকাতেও যদি বিরোধী মত প্রকাশের স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়ে, তাহলে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে রাজনৈতিক সহাবস্থানের অবস্থা সহজেই অনুমেয়।
এ অবস্থা শুধু এনসিপির জন্য নয়, বরং দেশের সামগ্রিক গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জন্যও অশনিসংকেত। কারণ, যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়, প্রতিহিংসাই হয়ে ওঠে রাজনীতির চালিকাশক্তি, সেখানে মতের বৈচিত্র্য নয়, বরং একনায়কতান্ত্রিক প্রবণতাই বিকাশ লাভ করে।
গোপালগঞ্জের সাম্প্রতিক হামলার ঘটনায় একটি অস্বস্তিকর ও উদ্বেগজনক চিত্র উন্মোচিত হয়েছে। পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকলেও হামলাকারীদের ঠেকাতে দৃশ্যত কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। বরং নির্বিকার দাঁড়িয়ে থেকে যেনো তারা হামলাকে মৌন অনুমোদনই দিয়েছে। এর চেয়েও দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, পথসভা ও গণসংযোগ কর্মসূচির আগে থেকেই হামলার আশঙ্কা থাকলেও পুলিশ বা স্থানীয় প্রশাসন পূর্বপ্রস্তুতি নেয়নি, কাউকে গ্রেফতার করেনি, কোনো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।
এই ধরনের নিষ্ক্রিয়তা নিছক অবহেলা নয়, বরং একটি গভীরতর রাজনৈতিক পক্ষপাতের ইঙ্গিতবাহী। এতে করে প্রশ্ন জাগে রাষ্ট্রের প্রশাসনিক যন্ত্র কি এখনো আগের সরকারের আনুগত্যে পরিচালিত হচ্ছে? এক-দুইজন নয়, একাধিক সূত্র থেকে অভিযোগ উঠেছে বর্তমানে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে ‘পতিত’ শাসকগোষ্ঠীর এজেন্টরা এখনো সক্রিয় রয়েছে। তারা সময় সুযোগমতো আওয়ামী কট্টর অনুসারীদের সহায়তা করছে, তাদের অপকর্মে চোখ বন্ধ রাখছে, এমনকি পরোক্ষভাবে পৃষ্ঠপোষকতাও দিচ্ছে।
যদি সত্যিই প্রশাসনের এই অংশ এখনো রাজনৈতিক পক্ষপাতের ধারক হয়, তাহলে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা কতটা ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে তা অনুধাবন করা কঠিন নয়। রাষ্ট্রের যেসব সংস্থা সাধারণ মানুষের জান-মাল রক্ষার জন্য নিয়োজিত, যদি তারাই নিষিদ্ধ সংগঠনের সহিংসতার মুখে নিরব থাকে, তাহলে সাধারণ মানুষ কোথায় দাঁড়াবে? কার কাছে যাবে? কে দেবে তাদের নিরাপত্তার গ্যারান্টি?
আজকের বাংলাদেশে এই প্রশ্ন কেবল বিরোধী রাজনীতির কর্মীদের নয়, বরং সাধারণ নাগরিকদের মধ্যেও বড় হয়ে উঠছে। রাষ্ট্র যদি নিরপেক্ষতা হারায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি পক্ষপাতদুষ্ট হয়, তাহলে শাসনের নৈতিক ভিত্তি ভেঙে পড়ে। এর ফলে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার এবং ন্যূনতম নাগরিক অধিকার সবকিছুই চরম ঝুঁকিতে পড়ে। গোপালগঞ্জের ঘটনাটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এই প্রক্রিয়া বন্ধ না হলে, দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা অচিরেই এক ভয়াবহ অনাস্থার মুখে পড়বে।
গণতন্ত্র কেবল ব্যালট নয়, এটি সহিষ্ণুতা, মতপার্থক্যের প্রতি শ্রদ্ধা, এবং সকল নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নীতিগত অঙ্গীকার। গোপালগঞ্জের ঘটনায় পুলিশ ও প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা যে বার্তা দেয়, তা শুধু দুঃখজনক নয়, ভীতিকরও। হামলাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে এই বার্তা ছড়িয়ে পড়বে আরও জেলাজুড়ে, আরও রক্তপাতের আশঙ্কা নিয়ে। সবচেয়ে বড় কথা, এই সহিংস প্রেক্ষাপটে দেশের সামনে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন কতটা সুষ্ঠুভাবে হবে তা নিয়েও এখন বড় ধরনের সংশয় তৈরি হয়েছে।
গোপালগঞ্জে জুলাই বিপ্লবের নেতাদের উপর হামলা শুধুই একটি দলীয় সহিংসতা নয়; এটি একটি মতাদর্শিক দমনপীড়নের প্রতিফলন। এটি দেখিয়ে দেয় বাংলাদেশে গণতন্ত্র এখনো কতটা নাজুক, কতটা সহনশীলতাহীন। এখন সময় এসেছে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা প্রমাণ করার, সহনশীলতা পুনঃস্থাপনের, এবং নাগরিক সমাজের আরও জোরালো হয়ে ওঠার। বিকল্প রাজনীতির কণ্ঠগুলোকে দমন না করে, বরং শ্রবণযোগ্য করে তোলার মধ্যেই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। অন্যথায় রাজনীতি পরিণত হবে এক ভয়ংকর ‘একক স্বরে’র স্বৈরতান্ত্রিক ব্যুহে, যেখানে বিরোধিতা মানেই বিদ্বেষ। এবং পরিবর্তন মানেই শত্রুতা।
কবি ও কথাসহিত্যিক
Bartabd24.com সব খবর সবার আগে