বিশেষ প্রতিবেদক :. মুহাম্মদ ইউনূস শান্তিতে নোবেল বিজয়ী এবং সামাজিক ব্যবসার প্রবক্তা, একটি বৈপ্ল বিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিশ্ববাসীকে পথ দেখিয়েছেন। তার থ্রি জিরো ভিশন- দারিদ্র্যমুক্ত, বেকারত্বহীন এবং কার্বন মুক্ত বিশ্বগঠনের ধারণা-মানবতার জন্য এক নতুন দিগ ন্ত উন্মোচন করেছে।
এই মডেল শুধু সমস্যাগুলোর দিকে আলোকপাত করে না বরং তা সমাধানের টেকসই উপায়ও উপস্থাপন করে। এটি এমন এক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখায় যেখানে মানবিক মূল্যবোধ ও পরিবেশগত ভারসাম্য একীভূত হবে।
থ্রি জিরো ধারণার প্রেক্ষাপট প্রথাগত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হচ্ছে মুনাফা বৃদ্ধি। তবে এই মুনাফাকেন্দ্রিক অর্থনীতি অনেক সামা জিক ও পরিবেশগত সমস্যার সৃষ্টি করেছে,যেমন দারি দ্র্য, বেকারত্ব এবং কার্বন দূষণ। ড. ইউনূস এই সমস্যা গুলোর গভীরে গিয়ে সমাধানের পথ খুঁজেছেন। তিনি মনে করেন, মানবিক মূল্যবোধভিত্তিক অর্থনীতি এবং সামাজিক ব্যবসা একসঙ্গে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে। তার থ্রি জিরো মডেল বিশ্বব্যা পী সমস্যা গুলো সমাধানের জন্য কার্যকর একটি কাঠামো।
পভার্টি (দারিদ্র্যমুক্ত বিশ্ব) ড. ইউনূসের মতে, দারিদ্র্য কোনো প্রাকৃতিক বিষয় নয়; এটি মানুষের তৈরি একটি অবস্থা। গ্রামীণ ব্যাংক প্রতি ষ্ঠার মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছেন যে, ক্ষুদ্রঋণ দরিদ্র জন গোষ্ঠীর আর্থিক স্বাধীনতা অর্জনে কতটা কার্যকর হতে পারে। দারিদ্র্য দূর করার জন্য থ্রি জিরো মডেল সামা জিক ব্যবসার ধারণা উপস্থাপন করে।
সামাজিক ব্যবসা একটি নন-ডিভিডেন্ড কোম্পানি, যে খানে মুনাফা সমা জের কল্যাণে পুনঃবিনিয়োগ করা হয়।
এ ধরনের ব্যবসা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য কর্ম সংস্থান তৈরি করে এবং তাদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাব লম্বী হতে সাহায্য করে। উদাহরণস্বরূপ, গ্রামীণ ব্যাংক শুধুমাত্র আর্থিক সহায়তা প্রদান করে না; এটি দরি দ্রদের উদ্যো ক্তা হতে উৎসাহিত করে। ফলে তারা নিজেদের অবস্থান উন্নত করার ক্ষমতা পায়।
জিরো আনএমপ্লয়মেন্ট (বেকারত্বহীন বিশ্ব):ড. ইউনূস বিশ্বাস করেন যে, প্রতিটি মানুষ জন্মগতভা বে উদ্যো ক্তা। তবে, প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা এবং সমাজে র কাঠা মো মানুষের সৃষ্টিশীল ক্ষমতা দমন করে।
তার থ্রি জিরো ভিশনে, সমাজে এমন একটি কাঠামো গড়ে তোলার আহ্বান জানানো হয় যেখানে প্রত্যেক মানুষ নিজের সৃজনশীলতা কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতি কভাবে স্বাবলম্বী হতে পারে। তিনি উদাহরণ হিসেবে যুবসমা জকে সামনে নিয়ে আসেন।
ক্ষুদ্র ঋণ ও সামাজিক ব্যবসার মডেল ব্যবহার করে যুবকদের উদ্যোক্তা হতে উৎসাহিত করা যায়।
উদাহরণস্বরূপ, গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে অনেকে ক্ষুদ্র ব্যবসা শুরু করেছেন, যা স্থানীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। একটি দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ গড়তে হলে বেকারত্ব দূর করাই মূল চ্যালেঞ্জ। তাই, থ্রি জিরো মডে ল শুধুমাত্র চাকরির সুযোগ সৃষ্টি নয়, বরং উদ্যোক্তা সৃ ষ্টির মাধ্যমে সমস্যার স্থায়ী সমাধান দেয়।
জিরো কার্বন এমিশন (কার্বনমুক্ত বিশ্ব) বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ক্রমেই ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। কার্বন নিঃসরণ ও পরিবেশ দূষণ রোধ না করলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য জীবনযাপন কঠিন হয়ে পড়বে। ড. ইউনূস মনে করেন, একটি পরি বেশবান্ধব অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। থ্রি জিরো মডেল নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার, সবুজ প্রযুক্তি গ্রহণ এবং পরিবেশবান্ধব সামা জিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দেয়। উদাহরণ স্বরূপ, ‘গ্রামীণ শক্তি’ সোলার প্যানেল সরবরাহ করে বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকায় নবায়নযোগ্য শক্তি ছড়িয়ে দিয়েছে। এটি গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নত করার পাশাপাশি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে সাহায্য করেছে।
থ্রি জিরো ভিশনের বৈশ্বিক প্রভাব :ড. ইউনূসের থ্রি জিরো মডেল ইতোমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনুপ্রে রণা হিসেবে কাজ করছে। বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা ও সরকার এই মডেল অনুসরণ করে সামাজিক ও অর্থ নৈতিক সমস্যার সমাধান করছে। উদাহরণস্বরূপ, ভার তে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে নবায়নযোগ্য শক্তি প্রকল্পগুলো থ্রি জিরো মডেলের আদর্শে পরিচালিত হচ্ছে। থ্রি জিরো ভিশন শুধু দরিদ্র দেশগুলোর জন্য নয়; এটি ধনী দেশগুলোর ক্ষেত্রেও প্রাসঙ্গিক। উদাহরণস্বরূপ, উন্নত দেশগুলোতে কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে ঝোঁক বাড়ছে।
চ্যালেঞ্জ ও সমাধান থ্রি জিরো মডেল বাস্তবায়নে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে ছে। প্রচলিত মুনাফাভিত্তিক অর্থনীতি, রাজনৈতিক বাধা এবং সচেতনতার অভাব এর অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। তবে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য শিক্ষার প্রসার, রাজনৈতিক সদিচ্ছা,
এবং সামাজিক উদ্যোগকে প্রাধান্য দিতে হবে। ড. ইউ নূস বিশ্বাস করেন, তরুণ প্রজন্ম এই মডেলের মূল চা লিকাশক্তি হতে পারে।
তারা যদি উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করে, তবে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত সমস্যাগুলো সহজেই সমাধান করা সম্ভব।
ড. ইউনূসের থ্রি জিরো ভিশন শুধু সামাজিক এবং অর্থ নৈতিক সমস্যার সমাধানের জন্য নয়; এটি একটি নতুন মানবিক সভ্যতা গঠনের ভিত্তি স্থাপন করতে পারে।
এই ধারণাটি একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের আহ্বান জানায়, যেখানে দারিদ্র্য, বেকারত্ব এবং পরি বেশগত সমস্যার মতো বিষয়গুলো আর মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না।
এটি শুধুমাত্র একটি অর্থনৈতিক মডেল নয়, বরং মানবিক মূল্যবোধ এবং পরিবেশগত সচেতনতার সমন্বয়ে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি।
শিক্ষার ভূমিকা ও থ্রি জিরো ঃড. ইউনূস মনে করেন, শিক্ষা একটি শক্তিশালী হাতিয়ার যা থ্রি জিরো মডেল বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থাকে আরো উদ্ভা বনী করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা নিজেদের সৃজন শীলতা বিকাশের সুযোগ পায়। তিনি ‘সামাজিক ব্যবসা র স্কুল’ ধারণা দিয়ে প্রমাণ করেছেন যে, শিক্ষার মাধ্যমে তরুণ প্রজ ন্মকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা যদি সামাজিক ব্যব সার ধারণা শেখে এবং এর মাধ্যমে কাজ শুরু করে, তাহলে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব কমানোর পথ আরও সুগম হবে। শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবেশবিষয়ক সচেতনতা বাড়া নো এবং নবায়নযোগ্য শক্তি নিয়ে কাজ করার সুযোগ তৈরি করাও প্রয়োজন।
গ্লোবাল পার্টনারশিপ ও থ্রি জিরোঘড. ইউনূসের ধারণা বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক অংশী দারত্ব একটি বড় ভূমি কা পালন করতে পারে। বিভিন্ন দেশ, আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং করপোরেট প্রতিষ্ঠান যদি একসঙ্গে কাজ করে, তবে থ্রি জিরো ভিশনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সহজ হবে।
উদাহরণস্বরূপ, জাতিসঙ্ঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য মাত্রা (SDGs)-এর সঙ্গে থ্রি জিরো মডেলের লক্ষ্যগু লোর গভীর সম্পর্ক রয়েছে। বিশ্বজুড়ে বড় বড় কর পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে যদি এই মডেলে বিনিয়োগ করে, তবে তা দারি দ্র্য দূরীকরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং পরিবেশ সংর ক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।
ভবিষ্যতের আশা:ড. ইউনূসের এই ভিশন কেবল ব র্তমান সমস্যার সমাধা নের জন্য নয় বরং ভবিষ্যৎ প্রজ ন্মের জন্য একটি নিরা পদ এবং উন্নত পৃথিবী গড়ে তোলার জন্য।
এটি আমাদের শেখায় যে, মুনাফার বাইরে গিয়ে যদি ব্যবসা এবং অর্থনীতিকে সামাজিক কল্যাণে কাজে লাগানো যায়, তবে পৃথিবীকে একটি বাসযোগ্য স্থানে রূপান্তর করা সম্ভব। তরুণ প্রজন্ম এবং সামাজিক উ দ্যোক্তারা যদি এই মডেলকে গ্রহণ করে এবং তাদের কাজের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে, তবে আগামী ৫০ বছরের মধ্যে আমরা দারিদ্র্যমুক্ত, বেকারত্বহীন এবং কার্বনমুক্ত একটি পৃথিবী গড়ে তুলতে পারব।
মুহাম্মদ ইউনূসের থ্রি জিরো ভিশন শুধু কোনো তা ত্তি¡ক মডেল নয়; এটি একটি বাস্তবসম্মত পথ, যা আমাদের দারিদ্র্য, বেকারত্ব এবং পরিবেশ দূষণমুক্ত একটি পৃথি বীর দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। তার ধারণা আমা দের দেখায় যে, সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং উ দ্যোগের মাধ্যমে সমাজের সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলো সমাধান করা সম্ভব। একটি মানবিক, ন্যায়ভিত্তিক এবং পরিবেশবান্ধব পৃথি বী গড়তে থ্রি জিরো মডেল বিশ্ববা সীর জন্য একটি যুগা ন্তকারী পরিবর্তনের পথচিত্র।
এটি শুধু আমাদের বর্তমান নয়, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও একটি টেকসই ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দেয়। থ্রি জিরো মডেল শুধু উন্নয়নশীল দেশের জন্য নয়;এটি উন্নত দেশগুলোর জন্যও কার্যকর হতে পারে। দারিদ্র্য এবং পরিবেশগত সমস্যার শিকড় প্রায় সব দেশেই বিদ্যমান।
এই মডেল যদি বিশ্বব্যাপী গ্রহণযো গ্যতা পায়, তবে তা হবে মানব ইতিহাসের একটি যুগান্ত কারী পদক্ষেপ। ড. ইউনূস দেখিয়েছেন যে, সঠিক পরি কল্পনা এবং মান বিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সব সমস্যার সমা ধান করা সম্ভব।
ড.ইউনূসের থ্রি জিরো ভিশন