মামুন পরভেজ হিরা,নওগাঁ ঃ নওগাঁ জেলা ধান-চাল উৎপাদনে বরাবরই এগিয়ে। চলতি বোরো মৌসুমের ধান কেটে ঘরে তুলতে ব্যস্ত চাষিরা। গেল বছরের তুলনায় এ বছর ভালো ফলন হয়েছে। কিন্তু বাজারগুলোয় মিলছে না চাষির কাঙ্খিত দাম।

ধান নিয়ে বাজার থেকে ফিরে চাষিদের মুখে নেই হাসি।এবার ২০ থেকে ২৮ মণ পর্যন্ত বাম্পার ফলন পাচ্ছেন চাষিরা। সদ্য কাটা-মাড়াই করা প্রতি মণ ধানের দাম পাওয়া যাচ্ছে ১ হাজার ৫০ টাকা থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকায়। তবে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় এ দাম যথেষ্ট নয় বলে দাবি করছেন প্রান্তিক পর্যায়ের চাষিরা। প্রতি মণ ধানের দাম কমপক্ষে ১ হাজার ৫০০ টাকা সরকারিভাবে নির্ধারণের দাবি জানিয়েছেন তারা।
কৃষকদের তথ্য মতে, প্রতি বিঘা বোরো আবাদে এ বছর জমি চাষ বাবদ ১ হাজার ৫০০ টাকা, ধান রোপণ বাবদ ১ হাজার ৩০০ টাকা, সেচ খরচ বাবদ ১ হাজার ৮০০ টাকা, ৩৫ থেকে ৪৫ কেজি ইউরিয়া সার বাবদ ৭৭০ টাকা থেকে ৯৯০ টাকা, ২০ কেজি ডিএপি সার বাবদ ৩২০ টাকা, ১৫ কেজি এমওপি সার বাবদ ২২৫ টাকা, ৩ থেকে ৪ ডোজ কীটনাশক প্রয়োগ বাবদ ১ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ২ হাজার টাকা, দেড় থেকে ২ কেজি জিংক বাবদ ৩৭৫ টাকা থেকে ৫০০ টাকা, ১ কেজি বোরন বাবদ ১৫০ টাকা, ধান কাটা বাবদ ৫ হাজার টাকা থেকে ৬ হাজার টাকা, বোঙ্গা মেশিনে মাড়াই বাবদ ৬০০ টাকা খরচ হচ্ছে।প্রতি বিঘা হিসেবে মোট খরচের পরিমাণ ১৩ হাজার ৫৪০ টাকা থেকে ১৫ হাজার ৩৮৫ টাকা।
আর ৯০ জাতের ধান বিক্রি হচ্ছে গড়ে এক হাজার ৩০০ থেকে এক হাজার ৪০০ টাকা পর্যন্ত। বর্তমানে হাটগুলোয় প্রতি মণ জিরা জাতের ধান বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ১০০ থেকে এক হাজার ৩০০ টাকায়।তবে কৃষকের দাবি এই দামে আমাদের পোষাবে না। এখন সর্বনিম্ন জিরা জাতের ধান এক হাজার ৪০০ থেকে এক হাজার ৫০০ টাকা মণ বিক্রি করতে হবে।
সদ্য কাটা-মাড়াই করা ধান হাটে বিক্রির পর খুশি মনে কৃষকের বাড়ি ফেরার কথা থাকলেও এ বছর ধানের বাজার দরে কৃষকের মুখে মলিনতার ছাপ দেখা যাচ্ছে।
গত ২ বছরে দফায় দফায় সার, ডিজেল ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিতে ধান উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া এবং বর্তমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রান্তিক পর্যায়ের চাষিদের। সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে যারা অন্যের জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করেন। টানা সাড়ে ৩ মাস হাড়ভাঙা খাটুনি শেষে প্রতি বিঘায় জমির মালিককে বুঝে দিতে হচ্ছে ফলনের অর্ধেক ফসল। বর্তমান ধানের বাজার দর অনুযায়ী বর্গাচাষিদের জন্য যা পুরোটাই লোকসান।
নওগাঁ সদর দুর্গাপুর গ্রামের কৃষক শামিম হোসেন বলেন, নিজের জমিজমা বলতে কিছুই নেই। তাই অন্যের জমি বর্গা নিয়ে ১ বিঘায় ৮ হাজার টাকা খরচ করে কাটারি জাতের ধানের আবাদ করেছিলাম। কমপক্ষে ২৫ মণ ফলন পাব বলে আশা করছি। ফসলের অর্ধেক দিতে হবে জমির মালিককে। এমনিতেই ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে ফসল আবাদ করেছি। এরমধ্যে শ্রমিক দিয়ে ধান কাটতে গেলে আরও বেশি ঋণগ্রস্ত হয়ে পরব। তাই নিজের ধান নিজেই কেটে ঘরে তোলার প্রস্তুুতি নিচ্ছি। বঙ্গা মেশিনে মাড়াই করতে দিতে হবে ৩০ কেজি ধান। সবমিলিয়ে ধানের বর্তমান বাজারমূল্য অনুযায়ী আমার পুরোটাই লোকসান।
নওগাঁ সদর দুবলহাটি ইউনিয়নের প্রতাপদহ গ্রামের কৃষক এনামুল বলেন, ৩ বিঘা জমিতে জিরাশাইল এবং ২ বিঘা জমিতে ব্রিধান-৮৮ জাতের ধানের আবাদ করে ১০৩ মণ ফলন পেয়েছি। আবাদের শুরু থেকে কাটা-মাড়াই পর্যন্ত খরচ হয়েছে প্রায় ৭০ হাজার টাকা। যা গত বোরো মৌসুমের তুলনায় ১৬ হাজার টাকা অতিরিক্ত খরচ। ৩ সপ্তাহ আগে ধান কাটার পর বাড়িতে বসেই ১০৫০ টাকা মণ দরে ৬ মণ ধান বিক্রি করেছি। এখন শুনছি ১ হাজার ২০০ টাকা মণ। ডিজেল, বিদ্যুৎ এবং সারের দাম দফায় দফায় বৃদ্ধিতে যেভাবে উৎপাদন খরচ বেড়েছে সে তুলনায় ধানের দাম খুবই কম। খরচ বেড়ে যাওয়ায় আদৌ আউশ আবাদ করবো কি না সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।
নওগাঁ সদর উপজেলার শৈলগাছী ইউনিয়নের শৈলগাছী গ্রামের কৃষক মোঃ উজ্জল হোসেন বলেন, দিঘলীর বিলে তিন বিঘা জমিতে কাটারি ও জিরাশাইল জাতের ধানের আবাদ করে ৮০ মণ ফলন পেয়েছি। নিজেদের খাবার জন্য ৪১ মণ জিরাশাইল ধান রেখে বাকী ৩৯ মণ কাটারি স্থানীয় বাজারে ৪২ হাজার টাকায় বিক্রি করেছি। প্রায় ৪০ হাজার টাকা খরচের পর নিজেদের খাওয়ার জন্য ধান রেখে মাত্র ২ হাজার টাকা কৃষকের পকেটে থাকা কখনোই যথেষ্ট হতে পারে না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে কৃষকদের স্বার্থে প্রতি মণ ধানের মূল্য সরকারিভাবে কমপক্ষে ১ হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারণের দাবি জানান তিনি। ধান উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির তুলনায় সরকার নির্ধারিত ধানের মূল্য ১ হাজার ২০০ টাকা নির্ধারণ খুবই কম। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকরা। তিন মাস কষ্টের পর উৎপাদিত ফসল খাওয়ার জন্য রেখে বাকিটা বিক্রি করলে কিছু টাকা উদ্বৃত্ত না থাকলে সেই ফসল চাষে কৃষকরা আগ্রহ হারাবে। সার ও সেচে খরচ বেড়ে যাওয়ায় বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী দেড় হাজার টাকার কমে ধান বিক্রি করলে চাষিদের পুঁজি সংকটে পড়তে হবে। এতে করে তারা বাধ্য হয়ে বিভিন্ন এনজিও ও সমবায় সমিতির চড়া সুদের ফাঁদে পরে একসময় চাষাবাদ ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে। তাই ধানের বাজারদর আবার বিবেচনার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
নওগাঁ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, তিন সপ্তাহ যাবত উৎসবমুখর পরিবেশে ধান কাটছেন তালতলী ও হাসাইগাড়ী বিলসহ বিভিন্ন মাঠের চাষিরা। শ্রমিক সংকট নিরসনে বাইরে থেকে কৃষি শ্রমিক আনতে সহায়তা করছে কৃষি বিভাগ। প্রায় ১০টি কম্বাইন্ড হারভেস্টার মেশিন মাঠে কাজ করছে। এবার ফসলের বাম্পার ফলন হওয়ায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগে ফসল কেটে ঘরে তুলতে পারায় ধান উৎপাদনে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশাবাদী তিনি। এ অঞ্চলের বেশিরভাগ চাষিরা ধান কাটার পরই স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে দিচ্ছেন। তাই তারা ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। ন্যায্যমূল্য পেতে হলে ধান সংরক্ষণের ধৈর্য এবং সংরক্ষণ ব্যবস্থা থাকতে হয়। সেটাও নেই অনেকের। ব্যবসায়ীরা এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কম দামে ধান কিনছেন। চাষিদের উৎপাদন খরচ বিবেচনায় ইতোমধ্যেই সরকার ধানের দাম বাড়িয়েছে। কৃষকরা যাতে ধানের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত না হয় সেজন্য বাজার মনিটরিং-এ জেলা প্রশাসনের সাথে স্থানীয় কৃষি বিভাগ কাজ করছে। ন্যায্যমূল্য পেতে চাষিদের আপাতত ধান সংরক্ষণ করার পরামর্শ দেন তিনি।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *