রহমত আরিফ ঠাকুরগাঁও সংবাদদাতাঃ ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হলে ছাত্রদের ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল রাণীশংকৈল মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে। ওইদিন তৎকালীন থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলী আকবর ও ছাত্রলীগের সভাপতি মিজানুর রহমান ছাত্রদের বলেছিলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী হুমকি দিয়েছেন যে, ট্যাংক দিয়ে হামলা চালিয়ে রাণীশংকৈল, হরিপুর ও পঞ্চগড় হয়ে ঢাকায় প্রবেশ করবে ভারতীয় সেনারা। তখন ভালো নামিদামি ও বড় অস্ত্র ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের হাতে।

পূর্ব পাকিস্তানে তেমন কোনো অস্ত্রসস্ত্র ছিল না। তাই ভারতের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের মোকাবিলা করা সম্ভব না। ভারতকে রোধ করতে হলে বুকে বোমা বেঁধে তাদের ট্যাংকের সামনে আত্মহুতি দেওয়া ছাড়া দেশকে রক্ষা করা সম্ভব না। বুকে বোমা বেঁধে আত্মহুতি দিলে হয়তো দেশকে রক্ষা করতে পারব। দেশকে বাঁচাতে আত্মহুতি দিতে কারা প্রস্তুত? তাদের এমন প্রশ্নে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন হাবিবুর রহমান।

রাণীশংকৈল উপজেলার বাচোড় ইউনিয়নের চোপড়া গ্রামের আব্দুল গোফুর ও পরিমন নেছার ঘরে ১৯৫২ সালের ৩ মার্চ জন্মগ্রহণ করেছিলেন, এই বীর বাঙালি মো. হাবিবুর রহমান।

ওই দিন মিটিংয়ে সর্বপ্রথম দেশের জন্য আত্মহুতি দিতে প্রস্তুত বলে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। একথা শুনে আলী আকবর ও মিজানুর রহমান বুকে জড়িয়ে ধরেন হাবিবুর রহমানকে। তাকে করেন থানা ছাত্রলীগের সহ-প্রচার সম্পাদক। পরে তাকে সহ-প্রচার সম্পাদক থেকে প্রচার সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়।

এর পর থেকে হাবিবুর রহমান ১৯৬৬’র ছয়দফা আন্দোলনের মিটিং মিছিলে অংশগ্রহণ করেন। ৬৯ এর গণ- অভ্যুত্থানসহ ৭০ এর নির্বাচনে সক্রিয়ভাবে ছাত্র রাজনীতিতে কাজ করেন তিনি।

যদিও তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্তমানে সব মনে করতে পারছিলেন না। তার পরেও তাৎক্ষণিকভাবে সেই ১৯৬৫ ও ৭১ সালের দিনগুলোর কথা মনে করে যুদ্ধে অংশগ্রহণের ঘটনার কথা ঢাকা মেইলকে বলেন বাঙালির বীর সন্তান মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান।

সেই ৭১ এর নির্মম দিনগুলো ও আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করে হাবিবুর রহমান বলেন, যখন বঙ্গবন্ধুকে আগরতলা মামলায় আটক করা হয়। তখন তিনি রাণীশংকৈল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের ক্লাশ ৬ষ্ঠ/৭ম শ্রেণির ছাত্র। একদিন ক্লাশে নফিজউদ্দীন নামে এক শিক্ষক সবাইকে শেখ মুজিবুরের খোশ গল্প শোনাচ্ছিলেন। স্যার বলেন, মিথ্যা মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানকে ধরে নিয়ে গেছে পাকিস্তান সরকার। দেখবে একদিন শেখ মুজিবুর রহমানই দেশ প্রধান হবেন।

ওই দিন সেই শিক্ষকের কথায় শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি দুর্বল হন হাবিবুর রহমান। ৭ মার্চে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে শিহরিত হয়েছিলন তিনি। বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণকে তিনি যাদু মনে করেন। সে কারণে তিনি একজন পাড়াগায়ের ছেলে হয়েও বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন যুদ্ধে যাওয়ার জন্য।

এভাবেই হাবিবুর রহমান স্মৃতিচারণ করে ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুনে স্থির থাকতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল কখন বন্দুক পাব আর কখন যুদ্ধে যাব! হঠাৎ একদিন আমাদের পাড়াটি রাজাকার ও বিহারিরা ঘেরাও করে। ওই দিন হাতে থাকা গামছাটি মাথায় বেঁধে, পরনের গেঞ্জি ছিড়ে, লুঙি হাটুর ওপরে বেঁধে পাগলের বেশ ধরেছিলেন বলে আল্লাহর রহমতে বেঁচে গিয়েছিলেন তিনি। পাগলের রুপ ধরে নাচানাচি করতে করতে রাজাকারদের বোকা বানিয়ে তাদের থেকে প্রায় ১শ গজ দুরে গেলে সেখানে একটি পাট ক্ষেতের মধ্য দিয়ে দৌড় দেন তিনি।

তিনি বলেন, পাট ক্ষেতের ওপারে দেখতে পাই আমার বাপ হালচাষ করছেন, তখন কাছে গিয়ে তাকে বলি আমাদের পাড়া ঘেরাও করেছে রাজাকার ও বিহারিরা। বাবা তখন আমাকে বাড়ি যেতে নিষেধ করেন ও পাট ক্ষেতে লুকিয়ে থাকতে বলেন। কারণ আমি ছাত্রলীগের কর্মী। তাই রাজাকার ও বিহারি এবং পাকিস্তানি দালালদের কাছে অর্থাৎ পিস কমিটির কাছে আমার নাম দিয়েছিল। তারা আমাকে পেলেই ধরে নিয়ে যেত।

এভাবে পাট ক্ষেতে দিনের বেলায় লুকিয়ে থাকতাম। আর রাতে ধান ক্ষেতের পাশে আম গাছের নিচে রাত্রিযাপন করতাম। লুকিয়ে খাবার পৌঁছে দিত আমার বাবা মা। এভাবে ১১ দিনের মাথায় একদিন গভীর রাতে একটি ব্যাঙ আমার মাথায় উঠে মুখে প্রস্রাব করে চলে যায়। সেই প্রস্রাব আমার মুখের ভেতরে ঢুকে যাওয়ার ফলে দীর্ঘক্ষণ বমি করি।
কথাটি হাস্যকর মনে হলেও তখন পাকিস্তানি দালালদের নির্মম অত্যাচারে ১১ দিন বাড়ির বাইরে থাকার ফলে সত্যিই এভাবে ব্যাঙের প্রস্রাব খেয়েছিলাম। ওইদিন ভোর বেলায় বাড়িতে গিয়ে আমার বাবাকে বলি, আমি ব্যাঙের প্রস্রাব খেয়ে থাকতে পারব না। মরতে যদি হয় আমি যুদ্ধ করেই মরব তবুও ব্যাঙের প্রস্রাব খেয়ে মরব না। আর এভাবে লুকিয়ে থাকতে পারব না। তখন আমি এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলাম।

কিছু দিন পর তিনি চলে যান ভারতে। ভারতে গিয়ে একটি বাড়িতে দিন মজুরের কাজ নেন তিনি। এক মুঠো মুড়ি, আঁধা কেজি চাল ও চার আনার বিনিময়ে সারাদিন কাজ করতেন তিনি। সেখান থেকে একদিন জানতে পারেন ভারতের বাহারাইল ক্যাম্পে মুক্তিযুদ্ধের জন্য মানুষ নেওয়া হচ্ছে। চলে যান সেখানে।

বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ১৯৭১ এর এপ্রিল মাসে চলে যাই সেই বাহারাইল ক্যাম্পে। সেখানে দুই সপ্তাহের প্রশিক্ষণ নিয়ে আবার আমাকে ভারতের পতিরামপুরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আমরা যারা একটু শিক্ষিত ছিলাম তাদেরকে প্যারামেডিকেলের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। যুদ্ধে কেউ আহত হলে তাদের তৎক্ষণিক প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার জন্য।

সেখানে প্রথমে আমরা এক সঙ্গে ৯৬ জন অস্ত্র চালানো ও প্যারামেডিকেলের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। মে মাসে আমাকে ৭ নাম্বার সেক্টরের বগুড়া সারিয়াকান্দি থানায় যুদ্ধের জন্য পাঠানো হয়। সেখানে গিয়ে অনেক জায়গায় যুদ্ধ করেছি। পরিশেষে একদিন শুক্রবার দিবাগত রাতে কমান্ডার শামসুল হকের নেতৃত্বে সারিয়াকান্দি থানায় পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে ত্রিমুখি আক্রমণ করি। কিন্তু আমরা একপাশ থেকে হামলা করলে আমাদের অপর দুইটি দল কোনো কারণবশত করতে পারেননি।

তাতে আমরা পাকিস্তানিদের তাড়া খেয়ে দৌড় দিলে এক পর্যায়ে পাকিস্তানিরা গুলি করে সেই গুলিটি আমার বাম কানের পাশ দিয়ে চলে যায়। তাতে মনে হচ্ছিল যে আমার বাম কানটি আর নেই। তখন আমি সারিয়াকান্দি বাঙালি নদীতে ঝাঁপ দেই। তখন আমি ডান হাতে বন্দুকটি ধরে আতঙ্কিত হয়ে পিপাসায় বাম হাতে একটু নদীর পানি খেয়ে নিই। আরেক বার যখন পানি খাওয়ার জন্য হাতে পানি তুলি তখন দেখি অর্ধেক পানি ও অর্ধেক রক্ত। এটি দেখে হতভম্ব হই। একটু দুরে তাকিয়ে দেখি যে সদ্য মরা গুলিবিদ্ধ লাশের রক্ত ভেসে আসছে। আর সেই রক্ত আমি না দেখে খেয়ে ফেলেছিলাম। সেটি ভেবে আমার বমি শুরু হয়।

এরপর সেখান থেকে ক্যাম্পে ফিরে এসে পর দিন ১১টা থেকে ১২টার সময় আবার পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে আক্রমণ করি। রোববার বিকাল পর্যন্ত গোলাগুলি চললে আমাদের দখলে চলে আসে সারিয়াকান্দি থানা। পরে আমার কমান্ডার শামসুল হক ও আমিসহ কয়েকজন অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে ৪৯ জন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারকে দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে গিয়েছিলাম আসামের কারাগার তুষার পাহাড়ে। তাদেরকে কারাগারে দিয়ে আবার আমরা তরঙ্গপুর ক্যাম্পে চলে আসি।

ওইদিন বাবা মাকে দেখার জন্য আমি কমান্ডারের কাছে কিছু দিনের ছুটি নিয়ে বাড়ির কাছাকাছি এসে পৌঁছালে, এখনও আমি বেঁচে আছি জেনে ও বাড়িতে আসছি শুনে আমার মা দৌড় দিয়ে এসে আমাকে সবার সামনে বুকে জড়িয়ে ধরেছিল। ওই মুহূর্তে আমি লজ্জিত হয়ে গিয়েছিলাম কারণ আমার মা এতোটাই দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন, যে দৌড়ে আসতে গিয়ে তার বুকের কাপড় কখন উড়ে পড়ে গিয়েছিল তা তিনি লক্ষ্যই করেননি। উল্লেখ্য-আগের মানুষরা অনেকে ব্লাউজ পরতেন না ওড়নার মতো কাটা কাপড় (পসড়া) পড়তেন। তাই দৌড়াতে গিয়ে হাবিবুরের মায়ের বুকের কাপড় উড়ে পরে যায়। এমন হৃদয় বিদারক ঘটনা বলতে গিয়ে অশ্রুসিক্ত হন হাবিবুর রহমান।

তিনি বলেন, বাড়ি এসে মিজানুর রহমানের কাছে শুনি যে ৩ ডিসেম্বর ঠাকুরগাঁও শত্রুমুক্ত হয়। এটি শুনে আমার বুক ভরে গিয়েছিল। আর আমি বাড়ি এসেছিলাম ৪ কিংবা ৫ ডিসেম্বরে। পরে আবার বগুড়ায় ক্যাম্পে গিয়ে অস্ত্র জমা দিয়ে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমি ১৭ ডিসেম্বর রোববারে আবার বাড়ি ফিরে আসি।

যুদ্ধের স্মৃতিচারণে তিনি বলেন, আমি স্বচক্ষে দেখেছি বিহারি, পাকিস্তানি ও রাজাকারদের অত্যাচার। যেখানেই রাজাকার ও বিহারিরা বাঙালিদের দেখত তারা খারাপ ভাষায় গালিগালাজ করতো ও গাদ্দারগাজা (গাধার জাত) বলত। এবং নানা ধরণের অত্যাচার করতো বাঙালি নারী-পুরুষের উপর। সেই নির্মম অত্যাচার আমার সহ্য হতো না। তাই আমি পাকিস্তান বাহিনী ও তাদের দালালদের হাত থেকে দেশকে, দেশের মানুষকে রক্ষা করতে যুদ্ধে গিয়েছিলাম।

আমার একটাই ত্যাগ ছিল যে আমার জীবন যাবে যাক। যেভাবেই হোক দেশ ও দেশের মানুষকে মুক্ত করতেই হবে। তাই নিজের জীবনকে মৃত্যুর সম্মুখে রেখে যুদ্ধ করেছিলাম। আমরা মুক্তিযোদ্ধারা টাকা পাওয়ার জন্য বা বাড়ি গাড়ি পাওয়ার জন্য যুদ্ধ করিনি। এখন নাহয় আমাদেরকে মাসে মাসে সম্মানি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু যখন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি তখন তারা কেউ বলেননি যে যুদ্ধ করলে নগদ বা বাকিতে কাউকে কোনো কিছু দেওয়া হবে। আমরা যুদ্ধে গিয়েছিলাম শুধুমাত্র দেশের স্বার্থে ও বাঙালি মানুষের স্বার্থে।

আমি ব্যাঙের প্রসাব খেয়ে, মানুষের রক্ত খেয়ে জীবনকে বাজী রেখে যুদ্ধ করেছি। আগে বিশ্বের কাছে আমাদের পরিচয় ছিল না। এখন আমরা পরিচয় পেয়েছি। নিজের ভাষায় কথা বলতে ও স্বাধীনভাবে চলতে পারি। তাই বেশি বেশি করে নতুন প্রজন্মকে ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬৯’র গণ-অভ্যুত্থান, ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ সর্ম্পকে, মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার আত্মত্যাগের কথা এবং ইতিহাস জানার ও উপলব্ধির জন্যে ব্যবস্থাগ্রহণে প্রশাসন ও স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকে আকুল আবেদন করছি। যেন আমাদের এই স্বাধীনতাকে কিয়ামতের আগ পর্যন্ত ধরে রাখা যায়। তাহলে আমাদের কষ্ট স্বার্থক হবে ও আমরা মরেও শান্তি পাব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *