ডেস্ক নিউজ;ব্যাপক শক্তি নিয়ে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখা কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম উপকূলের দিকে ধেয়ে আসলেও শেষ পর্যন্ত মিয়ানমার উপকূলে মূল ছোবল হেনেছে। ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রস্থল খানিক শক্তি হারিয়ে রবিবার (১৪ মে) বিকাল ৩টার দিকে কক্সবাজার ও উত্তর-মিয়ানমার উপকূল পার হয়। এতে সম্ভাব্য ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে বাংলাদেশ। বড় ধরনের জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কা থাকলেও উপকূলে এর মাত্রা ছিল সহনীয়।

তবে মোখার তাণ্ডবে কক্সবাজারে অনেক ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। এর মধ্যে সেন্টামার্টিনেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১২০০ ঘরবাড়ি। এছাড়া অসংখ্য গাছপালা উপড়ে পড়েছে। বার্তা সংস্থা এসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) জানায়, ঝড়ের তাণ্ডবে মিয়ানমারে তিনজনের প্রাণহানি হয়েছে। দেশটির আবহাওয়া বিভাগ জানিয়েছে, রাখাইন রাজ্যের সিট্যুয়ে শহরের কাছে ঘণ্টায় ২০৯ কিলোমিটারের বেশি গতিবেগ নিয়ে আছড়ে পড়ে ঘূর্ণিঝড় মোখার অগ্রভাগ।

দেশটির সেনাবাহিনীর তথ্য অফিস বলছে, ঝড়ের কারণে সিট্যুয়ে, কিয়াউকপিউ এবং গওয়া শহরে ঘরবাড়ি, বৈদ্যুতিক খুটি, মোবাইল ফোনের টাওয়ার, ল্যাম্পপোস্ট ও অনেক নৌকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দেশটির বৃহত্তম শহর ইয়াঙ্গুন থেকে প্রায় ৪২৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে কোকো দ্বীপপুঞ্জের বেশ কিছু ভবনের ছাদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

বার্তা সংস্থা এপি বলছে, রবিবার সকালের দিকে মিয়ানমারে ঝড়ো হাওয়া ও বৃষ্টিতে মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। দেশটির পূর্বাঞ্চলীয় শান রাজ্যের উদ্ধারকারী দল তাদের ফেসবুক পেজে জানিয়েছে, তারা তাচিলেক শহরে ভারী বৃষ্টির কারণে সৃষ্ট ভূমিধসে চাপা পড়া এক দম্পতির মরদেহ উদ্ধার করেছে। এছাড়াও স্থানীয় গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, মধ্য মান্দালয় অঞ্চলের পাইন ও লুইন শহরে গাছের নিচে চাপা পড়ে একজন মারা গেছেন।

বাংলাদেশের কক্সবাজারের উপকূলীয় এলাকায় এ ঝড়ের আঘাত হানার পূর্বাভাস দেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত তার মূল গতিপথ পাল্টে মিয়ানমারের রাখাইনের দিকে আগ্রসর হয়। উপকূলে আঘাত হানার আশঙ্কায় ১২ লাখ ৭০ হাজারের বেশি মানুষকে কক্সবাজারে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আজিজুর রহমান।

মোখার তাণ্ডবে সেন্টমার্টিন দ্বীপে গাছ চাপা পড়ে দুজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে তা নিশ্চিত করা হয়নি। রবিবার বেলা ২টার দিকে ঘূর্ণিঝড় মোখা সেন্টমার্টিনে আছড়ে পড়ে। ঘূর্ণিঝড়ে দ্বীপের মাঝরপাড়া, কোনারপাড়া, গলাচিপা, দক্ষিণপাড়া, পশ্চিমপাড়া, উত্তরপাড়ার অনেক ঘরবাড়ি ও গাছপালা ভেঙে পড়েছে। সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে উত্তরপাড়া, পশ্চিমপাড়া ও পূর্বদিকের বেশ কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। তিনটি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র, কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ৩৭টির বেশি হোটেল রিসোর্ট ও কটেজে অবস্থান করছিল প্রায় ছয় হাজার মানুষ।

সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, রবিবার সকাল থেকে দ্বীপের পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক ছিল। বেলা দেড়টার পর থেকে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করতে শুরু করে। বেলা ২টার পর প্রবল গতিবেগের ঝোড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টিপাত শুরু হয়। বিকেল ৪টা পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। এতে ঘরবাড়ি, গাছপালা ভেঙে পড়েছে। গাছ পড়ে আহত হয়েছেন ১৫ জন। এর মধ্যে একজন নারীর অবস্থা আশঙ্কাজনক।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণকক্ষের প্রধান সমন্বয়কারী ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) বিভীষণ কান্তি দাশ বলেন, ঝোড়ো হাওয়ায় সেখানকার প্রায় চারশ ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বেশকিছু গাছপালা ভেঙে পড়েছে বা উপড়ে পড়েছে। গাছ চাপায় এক নারীর আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ওই নারীর অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে তাকে জানানো হয়েছে। টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, সাবরাং এলাকাতে কিছু গাছপালা ভেঙে পড়েছে। এ ছাড়া জেলার অন্য কোথাও ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির তথ্য পাওয়া যায়নি।

সেন্টমার্টিন দ্বীপে গাছ পড়ে মৃত্যুর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মৃত্যুর বিষয়ে এখনো আমরা নিশ্চিত নই। তবে আহত হওয়ার খবর শুনেছি।

সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ফিরোজ আহমদ খান বলেন, জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে পাঁচ-ছয় ফুট উচ্চতায় বৃদ্ধি পেয়ে দ্বীপের সৈকতে আঘাত হানে। তাতে পূর্ব, উত্তর ও পশ্চিম সৈকতের ২০-২৫টি হোটেল রিসোর্টসহ লোকজনের কিছু ঘরবাড়ি প্লাবিত হয়েছে। তবে রাতে প্লাবনে ক্ষয়ক্ষতি বাড়তে পারে। জলোচ্ছ্বাস ঠেকানোর মতো টেকসই বেড়িবাঁধ সেন্টমার্টিনে নেই।

অন্যদিকে কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার সাবরাং ইউনিয়নের শাহ পরীর দ্বীপে ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে গাছপালা উপড়ে বাড়িঘরের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। শাহ পরীর দ্বীপের ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ড ঘুরে দেখা গেছে, গাছপালার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। অনেকের কাঁচা ঘরবাড়ির উপর এসব গাছ পড়ে ক্ষতি হয়েছে। বাজারে দোকানপাটও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কোথাও কোথাও টিনের চাল উড়ে যেতে দেখা গেছে।

কক্সবাজার আঞ্চলিক আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহকারী আবহাওয়াবিদ আব্দুর রহমান জানান, কক্সবাজারে সাত মিলিমিটার এবং সেন্টমার্টিনে ২২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রের্কড করা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় উপকূল অতিক্রম করার পর বৃষ্টিপাত বাড়তে পারে।

এর আগে ঘূর্ণিঝড় মোখা মোকাবেলায় কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়। শনিবার (১৩ মে) দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে ঘূর্ণিঝড় মোখা সংক্রান্ত ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির বাস্তবায়ন বোর্ডের জরুরি সভা শেষে প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান এ কথা জানান।

এছাড়া চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরসমূহকে আট নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়। উপকূলীয় জেলা ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহ আট নম্বর মহাবিপদ সংকেতের আওতায় ছিল। তবে এসব অঞ্চলে মোখার প্রভাবে তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *