Breaking News

যাকাত প্রদান ও পরিকল্পিত দায়িত্ববোধই করতে পারে বিশ্বকে দারিদ্র্য মুক্ত!!

জাহাঙ্গীর আলম :
আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য বিমোচন দিবস প্রতি বছর ১৭ অক্টো বর বিশ্বব্যাপী পালিত হয়। ( International Day for the Era dication of Poverty.) আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য বিমোচন দিবস।
১৯৮৭ সালের ১৭ অক্টোবর ফ্রান্সের প্যারিসে জাতিসংঘ সদ র দপ্তরের সামনে ১ লাখের বেশি মানুষ জড়ো হয়েছিলেন দরিদ্র মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা ও সংহতি প্রকাশ করতে।
এই আন্দোলনের ভিত্তিতেই ১৯৯২ সালে জাতিসংঘের সাধা রণ পরিষদ আনুষ্ঠানি কভাবে দিবসটি ঘোষণা করে। দিবসের মূল লক্ষ্য উদ্দেশ্য ছিল: বিশ্বের দরিদ্র জন গোষ্ঠীর দুরবস্থা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা,*দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সবাইকে ঐক্য বদ্ধ করা,* এবং সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে দারিদ্র্য দূরীকরণের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে উদ্বুদ্ধ করা।
১৯৯৩ সাল থেকে প্রতি বছর ১৭ অক্টোবর দিনটি পালিত হয়ে আসছে। কিন্তুু আজও দারিদ্র্য বিমোচন করা সম্ভব হয়নি। অথচ ইসলামী অর্থব্যাবস্থা ( যাকাত ভিত্তিক অর্থ ব্যাবস্থা )
১৪০০ শত বছর পূর্বে দারিদ্র্য বিমোচনের সঠিক সমাধান দিয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচন করতে ও ইসলামী অর্থ ব্যাবস্থার চাকা সচল করতে আল্লাহ তায়ালা যাকাত ব্যাব স্থাকে ফরজ করেছেন।
এবং অর্থ ব্যাবস্থাকে ভারসাম্য পূর্ণ করতে যাকাতের সম্পদ ব্যায় করার সুনির্দিষ্ট খাতও দিয়েছে। এ বিষয় আমরা বিস্তা রিত আলো চনা করব ইনশাআল্লাহ। তার আগে বিশ্বের দারি দ্র্য বিমোচনের অবস্থা সম্পর্কে কিছু জানি।
জাতিসংঘ সাধারণত প্রতি বছর একটি থিম ঘোষণা করে। সাম্প্র তিক বছরগুলোতে থিম ছিল দারিদ্র্য বিমোচন, সামা জিক ন্যায় বিচার, এবং টেকসই উন্নয়ন বিষয়ক।
২০২৫ সালের আনুষ্ঠানিক থিম হলো–Ending social and institutional mal treatment by ensuring res pect and effective support for famil ies” বাংলায় বলা যেতে পারে:  সামাজিক ও প্রতিষ্ঠানগত নির্যাতন বন্ধ করা পরিব রের প্রতি স ম্মান ও কার্যকর সহায়তা নিশ্চিত করা তবে 2024 সালের থিম ছিল: Dece nt Work and Social Protection: Putting dignity in practice for all.” “সম্মানজনক কাজ ও সামা জিক সুরক্ষা  সবার জন্য মর্যাদা নিশ্চি ত করা দরকার।
অথচ ইসলামী অর্থ ব্যাবস্থা না মানা, তথা যাকাত ভিত্তিক অর্থ ব্যাবস্থা না থাকা , জল বায়ু পরিবর্তন, যুদ্ধ- বিগ্রহ , বৈষম্য ও দুর্নী তি এই সমস্যা কে আরও গভীর করে তুলে ছে ।
ইসলামের দৃষ্টিতে দারিদ্র্য বিমোচনের সহজ উপায় : বর্ত মান বিশ্বে দারিদ্র্য একটি বৈশ্বি ক সংকট। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের প্রায় ৭০০ মিলিয়ন মানুষ আজ ও চরম দা রিদ্র্যের মধ্যে বাস কর ছে। তারা দিনে গড়ে ১.৯০ ডলার বা তার কম আয়ে জীবন যাপন করে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক বৈষম্য, বেকারত্ব এবং সম্প দের অসম বণ্টন দারিদ্র্যের অন্যতম কারণ।
এই পরিস্থিতিতে ইসলামী অর্থ নীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি যাকাত ব্যবস্থা। যা দারি দ্র্য বিমোচনে বৈপ্লবিক ভূমিকা রাখতে পারে। যাকাতের অর্থনৈতিক দর্শণ
‘যাকাত’ শব্দের অর্থ পবিত্রতা ও বৃদ্ধি। ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে এটি ধনী মুসলমা নদের ওপর একটি ফরজ আর্থিক দায়িত্ব। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন তাদের ( নিসাব পরিমাণ সম্পদে র মালিক ) সম্পদ থেকে যাকাত গ্রহণ করো, যার মাধ্যমে তুমি তাদের পবিত্র করবে ও পরিশুদ্ধ করবে।”
(
সূরা আত-তাওবা: আয়াত ১০৩) যাকাত কেবল ধর্মীয় কর্তব্য নয় এটি একটি সামা জিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যা সম্পদের ন্যায্য বণ্টন নিশ্চিত করে।জাতীয় পর্যায়ে যা কাতের ভূমিকা
বাংলাদেশে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, যদি দেশের সক্ষম মুসলমানরা নিয়মিতভাবে যাকাত আদায় করে, তাহলে বছরে আনুমানিক ৪০ হাজার কোটি টা কার বেশি অর্থ দারিদ্র্য বিমোচনে ব্যবহার করা সম্ভব।
এই অর্থ দিয়ে—দরিদ্র পরিবারকে কর্মসংস্থানে সহায়তা, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তৈরি , শিক্ষা ও চিকিৎসা সহায়তা, বেকার যুবকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব।পাকিস্তান ও মালয়ে শিয়ার মতো দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে যাকাত ফান্ড পরিচালিত হয়। যার মাধ্যমে হাজার হাজার পরিবার আত্মনির্ভরশীল হয়েছে।
বাংলাদেশেও সরকারি পর্যায়ে যদি যাকাত ভিত্তিক একটি শক্তি শালী ফান্ড গঠন করা যায় ,তবে তা সামাজিক সুরক্ষার বিকল্প হতে পারে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যাকা তের সম্ভাবনা বিশ্বে মুস লমানের সংখ্যা প্রায় ২০০ কোটির বেশি। গবেষণায় দেখা গেছে, মুসলিম দেশগুলো থেকে প্রতি বছর আ নুমানিক ৬০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যাকাত আদায়ের সম্ভাবনা রয়েছে। যদি এটি সম ন্বিতভাবে ব্যবস্থাপিত হয়, তাহলে বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য বিমোচনে এক বিশাল তহ বিল গঠন করা সম্ভব।
সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব ও ইন্দোনেশিয়ায় রাষ্ট্রীয় যাকাত ব্যবস্থার মা ধ্যমে ইতিমধ্যেই সামাজিক উন্নয়নে বিপুল সা ফল্য এসেছে। যেমন—ন্দোনেশিয়ার BAZNAS (National Zakat Agency) ২০২৩ সালে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার যা কাৃত সংগ্রহ করে, যা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করা হয়।
মালয়েশিয়ার Zakat Selangor সংস্থা বছরে প্রায় ১০ লাখের বেশি পরিবারকে অর্থনৈতিক সহায়তা দেয়। যাকাতের অর্থ, ইস লামী অর্থব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। দারিদ্র্য বিমোচনের মডেল। মাসারিফুস যাকাত (مَصَارِفُ الزَّكَاةِ) অর্থাৎ যাকা তের খরচের ক্ষেত্রসমূহ” বা “যারা যাকাত পাওয়ার অধিকারী”এগুলো আল্লাহ তাআলা কুরআনে স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করেছেন।
আল-কুরআন:
إِنَّمَا الصَّدَقَاتُ لِلْفُقَرَاءِ وَالْمَسَاكِينِ وَالْعَامِلِينَ عَلَيْهَا وَالْمُؤَلَّفَةِ قُلُوبُهُمْ وَفِي الرِّقَابِ وَالْغَارِمِينَ وَفِي سَبِيلِ اللَّهِ وَابْنِ السَّبِيلِ ۖ فَرِيضَةً مِّنَ اللَّهِ ۗ وَاللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ
অর্থ যাকাত তো কেবল ফকির, মিসকিন, যাকাত আদায়ের কাজে নিয়োজিতদের জ ন্য, যাদের মন ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করা উদ্দে শ্য, দাসমুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে (জিহাদ ও দ্বীনি কাজ বাস্তবায়ন করার জন্য) এবং মুসাফিরদের জন্য  এটা ই আল্লাহর নির্ধারিত বিধান। আর আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।”
(সূরা আত-তাওবা: আয়াত ৬০) এখানে যাকাতের ৮টি খাত (মাসা রিফ) উল্লেখ রয়েছে। যেমন-১. الفقراء (আল-ফুকারা) যারা একে বারে গরিব, মৌলিক চাহিদা পূরণে অক্ষম।
. المساكين (আল-মাসাকিন) যারা কিছুটা উপার্জন করে, কিন্তু তাতে পুরো প্রয়োজন মেটে না।
৩. العاملين عليها (আমিলিন ‘আলাইহা)  যাকাত সংগ্রহ ও বিতর ণের কাজে নিয়ো জিত কর্মচারী।
. المؤلفة قلوبهم (মুআল্লাফাতুল কুলুব)  যারা সদ্য ইসলাম গ্রহণ করেছে বা যাদের হৃদয় ইসলামমুখী করার প্রয়াস নেওয়া হচ্ছে।
৫. في الرقاب (ফি রিকাব) — দাস-মুক্তির জন্য (বর্তমানে দাসপ্রথা না থাকায় বন্দি মুক্তি বা মানবিক দাসত্বের অনুরূপ ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়)।
الغارمين (আল-গারিমিন) ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি, যিনি নিজের মৌলিক প্রয়োজন মেটাতে ঋণ নিয়েছেন এবং তা পরিশোধে অক্ষম।. في سبيل الله (ফি সাবিলিল্লাহ) আল্লাহর পথে ব্যয়, যেমন: জিহাদ, দাওয়াত, ইসলাম প্রচার, দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মানবসেবা ইত্যা দি।
৮. ابن السبيل (ইবনুস সাবিল) মুসাফির (পথিক), যিনি ভ্রমণের কা রণে অর্থহীন হয়ে পড়েছেন এবং গন্তব্যে পৌঁছাতে সাহায্য প্রয়ো জন। এই আট শ্রেণির বাইরে যা কাত দেওয়া জায়েয নয়। রাষ্ট্র বা ব্যক্তি উভয়েই যাকাত এই নির্ধারিত খাতে বিতরণ করবে, যাতে সমাজে সম্পদের সুষম বণ্টন ও দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব হয়।যদি সরকার ও বেস রকারি প্রতিষ্ঠানগুলো একত্রে যাকাত তহবি লকে নিম্নোক্তভাবে পরিচালনা করে, তবে দারিদ্র্য বিমোচন করা সম্ভব। যেমন কিছু করণীয় কাজ তুলে ধরা যাক – কেন্দ্রীয় যাকাত বোর্ড গঠন
*
স্বচ্ছ তথ্যভিত্তিক দরিদ্র তালিকা তৈরি বিনিয়োগমুখী যাকাত বিত রণ (যেমন ক্ষুদ্র ব্যবসার জন্য ঋণ প্রদান করে কর্ম সংস্থানের ব্যব স্থা করে দেওয়া। ডিজিটাল যাকাত প্ল্যাটফর্ম চালু করা।
যাকাত তহবিল থেকে অসহায়দের জন্য শিক্ষা, চিকিৎসা ও আবাসন খাতে ব্যয় করা।
এক কথায়, ইসলামে দারিদ্র্য বিমোচনের কাজ করাও একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। কোরআনে আল্লাহ বলেন: তোমরা সালাত কায়েম করো এবং যাকাত দাও।”
(সূরা আল-বাকারা: ৪৩) রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: “উপরের হাত (দানকারী) নিচের হাতের (গ্রহণকারী) চেয়ে উত্তম।”সহিহ বুখারি)
অর্থাৎ ইসলামে ধনীদের সম্পদের একটি অংশ দরিদ্রদের অধি কার হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে।
যাকাত কেবল ধর্মীয় দায়িত্ব নয় এটি একটি মানবিক ও অর্থনৈ তিক সংস্কার ব্যবস্থা। বিশ্বব্যাপী মুসলমানরা যদি সঠিকভাবে যাকা ত আদায় করে এবং সরকার তা সুশা স নের মাধ্যমে পরিচালনা করে, তবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ভাবে দারিদ্র্য বিমোচন করা সম্ভব। যাকাত ভিত্তিক অর্থব্যবস্থা বাস্তবায়ন করলে, দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ গঠন আর কল্পনা নয়, বাস্তবতা রুপ নিতে পারে।
লেখক : প্রভাষক জাহাঙ্গীর আলম, কলামিস্ট, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী। ০১৯১১৬০৪৪৫৫।

About admin

Check Also

ইসলামের দৃষ্টিতে চুল দাঁড়িতে কলপ লাগানোর বিধান!!

ঃপ্রভাষক জাহাঙ্গীর আলমঃ আমাদের দেশে মানুষের মধ্যে চুল দাঁড়িতে কালার করা নিয়ে মানুষের মধ্যে কিছু …

One comment

  1. যাকাত প্রদান ও পরিকল্পিত দায়িত্ববোধই করতে পারে বিশ্বকে দারিদ্র্য মুক্ত!!