: আলমগীর মতিন চৌধুরী: শুভ সকালে লেখনীর যাত্রাশতভাগ ঝুঁকিতে সাংবাদিক ও সাংবাদিকতা: আলমগীর মতিন চৌধুরী, কাগজ কলম হাতে নিয়ে স্মৃতির পাতা খুলে দিতেই ভিতরে জমানো কথাগুলো হুড়-হুড় করে একসাথে সব বেরিয়ে আসছে।
ভেবে পাচ্ছিনে, কোথা হতে আরম্ভ করবো। ইতিহাস প্রবাহমান কালের স্বাক্ষ্য বহণ করে আর ধারণ করে লেখক,সাংবাদিক ও গণমাধ্যম। সংবাদপত্রের ইতিকথা কবে, কখন, কোথায়, কে প্রথম আরম্ভ করেছে তা সঠিক ভাবে বলা সম্ভব নয়। ঠিক পৃথিবী সৃষ্টি রহস্যের মতো। ধ্রুপদী সভ্যতা শুরু হয়েছিল প্রাচীন গ্রীসের নগর রাষ্ট্রের মধ্যদিয়ে। রোম সভ্যতার গোড়ার দিকে ১৮২ খ্রীষ্টাব্দে সা¤্রাজ্য অধিপতিরা নিজ-নিজ প্রয়োজনে খবরের যাত্রা শুরু করে। কালের বিবর্তনে পরিমার্জিত হয়ে চীন, ইটালীর ভেনিস, ইংল্যান্ডের রানী এলিজাবেথের শাসনকালে আরম্ভ হওয়া সংবাদপত্রই আজকের আধুনিক সংবাদমাধ্যম।
উপমহাদেশে স¤্রাট আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে হাতে লেখা খবরে কাগজের কথা প্রচলিত থাকলেও প্রকৃতপক্ষে ২৭৫ খ্রীষ্টাব্দে মহারাজা শ্রীগুপ্ত ক্ষমতায় আসার পর রাজ্যে গুপ্ত প্রথা চালু করেন। রাজাকে রাজ্যের সার্বিক পরিস্থিতি জানানোই গুপ্তৃ বা খবর বাহকদের কাজ ছিল। তবে ৯৭৭ খ্রীষ্টাব্দে মহীপালের শাসনাকালে বিশ্বস্থ ব্যক্তিদের নিয়ে ডাক হরকরা প্রতিষ্ঠা করে যাদের কাজ ছিল রাজ্যে খবরাখবর সংগ্রহ ও সরবরাহ করা।
ইতিহাস মতে ভারত উপমহাদেশে সরকারের তত্ত্বাবধানে ১৭৮০ সালে ইংরেজীতে মুদ্রিত ‘বেঙ্গল গেজেট’ প্রথম পত্রিকা। কালক্রমে তা ক্ষমতাসীনদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। ১৮১৮ সালে ক্লার্ক মার্শম্যানের সম্পাদনায় দিকদর্শন, ১৮৩১ সালে ঈশ্বরগুপ্তের সংবাদ প্রভাকর, ১৮৪৭ সালে কালীচন্দ্র রায় চৌধুরীর রঙ্গপুর বার্তাবহ ১৮৬৩ সালে শ্রী হরিনাথ মজুমদারের গ্রাম বার্তা, যা হয়ে উঠেছে মেধা বিকাশের সিঁড়ি, মানুষের অধিকার আদায়ের মুখপাত্র।
তারপর থেকে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে গণমাধ্যম অসামান্য অবদান রেখে চলেছে। বর্তমানে সমাজ, রাষ্ট্র ও জাতির কাছে গুরুত্বের দিক থেকে সংবাদপত্র তথা গণমাধ্যম শীর্ষে অবস্থান করছে। আলোচক-সমালোচকরা বলে থাকে, টাকা মহান ঈশ্বরের একটু নীচে। আসলে সেটা কতটুকু সত্য জানা নেই, তবে জীবনের সাথে শতভাগ অর্থ জড়িয়ে আছে।
বিগত শতাব্দীর শুরুতে আধুনিক প্রযুক্তির একটি ব্যর্থ চ্যালেঞ্জ ছিল আটলান্টিক মহাসাগরে ১৩ লাখ পাউন্ডে ২৭৫ মিটার দৈর্ঘ্য ১০৪ মিটার উচ্চ ৬০ হাজার টন ওজনের বিলাসবহুল প্রমোদ তরী টাইটানিক, ২ হাজার দু’শ তেইশ যাত্রী ও আট’শ পঁচাশি জন জাহাজের কর্মী নিয়ে মর্মান্তিক সলিল সমাধি। আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে সম্মুখ লড়াইয়ে পরাজিত করে, শত্রু সমাধি রচিত প্রথম মুক্ত বাংলার পবিত্র মাটি একেবারে সীমান্ত ঘেঁষা চৌগাছা। একঝাক তরুণ প্রতিভাবন উদ্দোমী সংবাদ কর্মীর রক্ত-ঘামে গড়ে উঠা মিলন কেন্দ্র প্রেসক্লাব।
চলমান প্রতিকুল পরিবেশ উপেক্ষা করে প্রেসক্লাবের সাংবাদিক সহকর্মী বন্ধুরা স্মারক সংখ্যা-২০২০ প্রকাশ আরো একটি চ্যালেঞ্জ। কিন্তু অবিশ্বাস্য ব্যয়বহুল খরচের কথা চিন্তা করতেই আমার উত্তর আয়ারল্যান্ডের হোয়াইট ষ্টার লাইনের তত্ত্বাবধায়নে ১৯০৭ সালে আরম্ভ হয়ে ১৯১২ সালের ১০ এপ্রিল রয়াল মেল ষ্টিমার টাইটানিকের যাত্রা কথা মনে পড়ে গেলো।
আনুমানিক রাত নয়টা। উপজেলার প্রাচীর ঘেঁষা গফুরের চায়ের দোকানে কয়েকজন সহকর্মীর সাথে আড্ডা দিচ্ছি। এমন সময়ে প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শক্তিধর কলম যোদ্ধা কবি শাহানুর আলম উজ্জ্বল স্মারক সংখ্যা প্রকাশের কথা আমাকে জানালো। সিন্ধান্ত দিতে তার কথায় আমি শুধু চমকে উঠিনি, ভয়ও পেয়েছি।
উত্তরহীন প্রশ্নে এক পলকে তারদিকে বেশ কয়েক মিনিট চেয়ে থাকলাম। অসুস্থ্য হয়ে পড়ায় স্বারক সংখ্যার কথা ভুলেইগেছি। গতরাতে ফোনে জানালো ‘ভাই হাতে সময় খুব কম আগামীকাল দুপুরের মধ্যে অবশ্যই এই সংখ্যায় আপনার একটি লেখা দিতে হবে। লেখার মতো মানুষিক অবস্থা নেই তবুও তাকে বারন করিনি, গতি থামিয়ে দেয়নি।
আমি কথা দিয়েছি, স্বল্প সময়ে কষ্ট হলেও একজন সংবাদকর্মী হিসাবে সম্পুর্ণ পেশাগত অধিকারের জায়গা থেকে লিখতে মোটেও কার্পণ্য করবো না। মানব জাতিকে সৃষ্টির গোড়া থেকে প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে পৃথিবী জয় করতে হয়েছে।
মনে পড়ে ২৫ বছর আগে হলওয়েল ইউনির্ভাসিটির লাইব্রেরীতে বসে মধ্যযুগের বিখ্যাত দার্শনিক মি. জন হার্ডসনের লেখা একটি বইতে পড়েছি, ১৫ লাখ বছর আগে পৃথিবীতে হোমো হাবিলিস নামে এক প্রকার প্রাণী ছিল তারাই মানবের আদি রূপ। তার বহুপরে প্রায় কুড়ি হাজার খৃষ্টপূর্বে প্রবল পানির চাপে মানব যাত্রা প্রথম ব্যাহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। সেই যাত্রায় অর্ধেক পৃথিবী পানির তলদেশে হারিয়ে যায়।
জেগে থাকা বিশ্বের ৬ হাজার মানুষের মধ্যে ৩ হাজার নর-নারী মারা যায়, দু’শো প্রজাতি নিধন হয়েছে। ভয়ে আমার বুক কেঁপে উঠলো, সেই মুহুর্তে বইটি আর পড়া হলো না। ভাবতে থাকি আমাদের বেঁচে থাকার লড়াই সংগ্রাম ঘাত প্রতিঘাত বড়ই নির্মম, বড়ই নিষ্ঠুর। তার থেকে নিষ্ঠুর নির্মম শতভাগ ঝুকিতে আজকের সাংবাদিক ও সাংবাদিকতা।
১। এই যুগের ক্ষমতা ধর ব্যক্তিরা যখন সভা-সেমিনারে গলা ফাটিয়ে বলে আধুনিক বিশ্ব, চলছে বৈজ্ঞানিক যুগ। পৃথিবী শতভাগ সভ্যতার মোড়কে আটা। তখন চিৎকার করে প্রতিবাদী কন্ঠে আমারও বলতে ইচ্ছে করে, বাঙালী মেয়ে ফেলানীর লাশ কাটাতারে ঝুলছে কেন? সদ্য কালের কন্ঠে প্রকাশিত সাত বছরের শিশু আঁখির জীবন লোহার শিকলে বন্দী কেন? সোনালী খবরে প্রকাশিত রোদ বৃষ্টি শীতে বুলবুলির ঠিকানা খোলা আকাশের নীচে কেন ? বাংলাদেশের আলো পত্রিকায় প্রকাশিত মাস্তানের দাপটে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধার বৃদ্ধা স্ত্রী বাড়ি ছাড়া কেন ? গ্রামের কাগজে প্রকাশিত সংখ্যা লঘুরা সমাজে অধিকার বঞ্চিত কেন? হতদরিদ্র অসহায় মানুষের সরকারি অনুদান শীতের কম্বল- ক্ষুধার্তের খাবার মাটির নীচে পুতে রাখা হয় কেন? বাস্তহারা মানুষের জন্য পাঠানো টিনগুলো সমাজ প্রতিদের ঘরে শোভা পায় কেন ? অসভ্যরা মরা মানুষের ভাতা তুলে পকেটস্ত করে কেন ? জনগণের অধিকার লুটপাট হয় কেন ? সারাবিশ্বে প্রায় শতকোটি মানুষ ঠিকানাহীন কেন? এমন হাজারো অজানা প্রশ্নের উত্তর জানতে ইচ্ছে হয়।
এখনো কান পাতলে অপরাধীর অপ্রতিরোধ্য হুংকার শুনতে পাই, দেখতে পাই অপরাধের আগামী নীলনকশা। এই জন্য কি আজ সত্যটা বলতে মানা? নষ্ট রাজনীতির সুরোতহাল রিপোর্ট জনতা বুঝে যাবে। জাতির কাগজে লেখা সংবিধানে মৌলিক অধিকারের কথা নাগরিক সাধারণ জেনে যাবে। একই রাজ্যে সুবিধাভোগী আর বঞ্চিতদের বিভাজনে সম্পর্কের বৈরীতা দেখাদিবে।
নানা কারণে ক্ষমতা ধরদের চলমান সমাজের বাস্তবতা মাটির নীচে পুতে রাখতে হবে। যারা এই অপশক্তির অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে, বুলেটের সামনে জীবন বাজি রেখে সত্যটা প্রকাশ করে তারাই কলমযোদ্ধা। যাদের লেখনীতে পথহারা বঞ্চিত উপেক্ষিত মানুষের অধিকার-স্বাধীকার বিশ্ব মানবতার চিত্র ফুটে উঠে তারাই সাংবাদিক। এই কারণে পেশাদার সাংবাদিকের পেশার জায়গাটিকে বলা হয় রাষ্ট্রের “চতুর্থ স্তম্ভ”। বর্তমানে বিশ্ব তথা বাংলাদেশে সর্বাধিক ঝুঁকি নিয়ে যাদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে, গণমাধ্যম কর্মী সাংবাদিকরা তাদের অন্যতম।
নীতিহীন অপশক্তি সুবিধাভোগী বেষ্টিত জনবহুল অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে সাংবাদিকতার ঝুঁকি অনেক বেশি। খুব কাছের থেকে দেখা, আমার প্রিয়জন্ম ভুমি ছোট্ট দেশটির প্রধানমন্ত্রী বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনা। তিনি সদাসত্য বচনে বিশ্বাসী, সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলেন। বিশ্বের একমাত্র সরকার প্রধান শেখ হাসিনা, যিনি সত্য কথা বলে কখনো কখনো নিজের সরকারকে সমালোচনায় মুখে ঠেলে দেন। দল ও বিরোধী দলগুলোর মধ্যে বহুবার সমালোচিত হয়েছেন কিন্তু ততোবারই জনগণের কাছে সমাদৃত হয়েছেন, নন্দিত হয়েছেন। দেশ-বিদেশে বিশ্বস্থতা অর্জন করেছেন। স্বাধীনতার পর তার শাসনামলে সর্বোচ্চ বেসরকারি, মালিকানাধীন গণমাধ্যম সৃষ্টি হয়েছে। সাংবাদিক-সাংবাদিকতার ক্ষেত্র-পরিধি বিস্তার লাভ করেছে। অপ্রিয় হলেও সত্য, এই আমলেই দেশে বেশি সাংবাদিক নির্যাতন-হত্যার শিকার হয়েছে।
সাংবাদিকতার ঝুঁকিতে রেডজোনে থাকা আফগানিস্থান, উত্তর কোরিয়া, ইউক্রেন, ব্রাজিল, কঙ্গো, হাইতি, যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো, ফিলিপাইন, সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া, ইয়েমেন, সৌদি আরবের মতো রাষ্ট্রগুলোর সাথে বাংলাদেশও যুক্ত হয়েছে। পার্থক্য শুধু রেডজোনের দেশগুলোতে সরকার-রাষ্ট্রপ্রধান সরাসরি সাংবাদিক এবং সাংবাদিকতার সমালোচনা-বিরোধীতা করে, সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনার সাথে জড়িত থাকে। আমার দেশের সরকার-রাষ্ট্রপ্রধান তা করে না।
২। দেশের ‘চতুর্থ স্তম্ভ’ ক্ষতিগ্রস্থ হলে গণতান্ত্রিক ধারা বিধ্বস্ত হয়। সাধারণ মানুষ অধিকার হতে বঞ্চিত হয়। ন্যায়বিচার, সুশাসন, উন্নয়নের গতি হারিয়ে ফেলে। জানা শোনা মুক্ত পথ রুদ্ধ হয়। তখন সাংবাদিকের কলম ন্যায়ের প্রতীক হয়ে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যমে জাতির যেকোনো সংকট, ইস্যু মীমাংসায় পথ দেখায়। সমাজ রাষ্ট্রের সার্বিক কর্মক্ষেত্রকে পরিশুদ্ধ করে তুলতে সহায়তা করে। এই চিন্তা চেতনা থেকে যদি কোনো ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান সরে যায় তখন মনে করতে হবে সেখানে প্রজা সাধারণের অধিকার বিপন্ন হচ্ছে। সেই জাতির সুনামের মুল ধারায় ঘুণ লেগেছে। সরকার জনবিছিন্ন হয়ে পড়েছে।
অনেক বীর সন্তানদের বুকের তাজা রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করে ১৯৯০ সালে অগণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করে আমরা যে গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখেছিলাম, সেই গণতান্ত্রিক ধারা কি আমাদের দেশে অব্যাহত আছে? এই প্রশ্নের উত্তর কে দিবে ? ৯০’র পর থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ৩১ জন সাংবাদিক নির্মমভাবে খুন হয়েছে। ১৯৯৬ সালের ১৯ ফেব্রয়ারি, নীল সাগর পত্রিকার কামরুজ্জামান, একই সালের ১৯ জুন পত্রদূত সম্পাদক প্রবীণ সাংবাদিক স.ম আলাউদ্দীন। ১৯৯৮ সালের ৩০ আগষ্ট যশোর থেকে প্রকাশিত দৈনিক রানার পত্রিকার সম্পাদক সাইফুল আলম মুকুল।
২০০০ সালের ১৫ জানুয়ারি, বীর দর্পণ পত্রিকার মীর ইলিয়াস হুসাইন, ১৬ জুলাই দৈনিক জনকন্ঠ পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি শামসুর রহমান কেবল। ২০০১ সালের ২১ এপ্রিল অনির্বান পত্রিকার নাহার আলী। ২০০২ সালের ২ মার্চ দৈনিক পূর্বাঞ্চল পত্রিকার সিনিয়র রিপোর্টার হারুন অর রশিদ, ৫ জুলাই অনির্বান পত্রিকার শুকুর আলী, ৩ আগষ্ট দৈনিক পূবালী বার্তার সৈয়দ ফারুক আহমেদ। ২০০৪ সালের ১৫ জানুয়ারী বিবিসি ওয়াল্ড ও দৈনিক সংবাদ প্রতিনিধি একুশে পদক প্রাপ্ত মানিক সাহা, ২৭ জুন দৈনিক জন্মভূমি পত্রিকার সম্পাদক প্রবীণ সাংবাদিক হুমায়ুন কবির বালু, ২৭ আগষ্ট কামাল হোসেন, ২ অক্টোবর দীপঙ্কর চক্রবর্তী, ২৪ অক্টোবর এশিয়ান এক্সপ্রেসের আনোয়ার। ২০০৫ সালের ১১ ফেব্রয়ারী সংগ্রামের বেলাল উদ্দীন, ৩১ মে মুক্তকন্ঠের গোলাম মাহফুজ, ১৭ নভেম্বর সমকাল পত্রিকার ফরিদপুর প্রতিনিধি গৌতম দাস। ২০০৬ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর জনবাণীর বেলাল দফাদার। ২০১১ সালের ২৮ জানুয়ারী দৈনিক জনতার ফরহাদ খাঁ। ২০১২ সালের ১১ ফেব্রয়ারি এটিএন বাংলার মেহেরুন রুনী, মাছরাঙ্গা টিভির সাগর সরোয়ার, ১২ মে অনন্ত বিজয় দাস, ৫ জুন দৈনিক গ্রামের কাগজের জামাল উদ্দীন, ১০ জুলাই দৈনিক বিবিয়ানা পত্রিকার জুনায়েদ আহমেদ, ২৩ অক্টোবর নরসিংদীর বাণী পত্রিকার তালহাদ আহমেদ। ২০১৪ সালের ৪ মার্চ অপরাধ দমন পত্রিকার শাহ আলম মোল্লা, ২৮ মার্চ সমাচার পত্রিকার দেলোয়ার হোসেন। ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রয়ারী অভিজিৎ রায়, ৩০ মার্চ ইস্টিশন পত্রিকার ওয়াশিকুর রহমান বাবু, ২৪ ডিসেম্বর যুগের আলো পত্রিকার মশিউর রহমান উৎস। ২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল জুলহাস মান্নান, ২০১৭ সালের ৩ ফেব্রুয়ারী সিরাজগঞ্জের আবদুল হাকিম শিমুল। ২০১৮ সালের ২৮ আগষ্ট আনন্দ টিভির সুবর্ণা নদীসহ বিভিন্ন সময়ে দুঃশাসন অপশক্তির শিকার অগণিত সাংবাদিক সহযোদ্ধাকে হারিয়েছি। দিন যাচ্ছে আর সাংবাদিক খুন-নির্যাতনের হার বাড়ছে, এই চিত্র বাংলাদেশে নয় সারা বিশ্বে। বিভিন্ন দেশে বিগত ২৫ বছরে ২ হাজার আটশ ছাপ্পান্ন জন সাংবাদিককে হত্যা ও প্রায় ৪৮ হাজার সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। পঙ্গুত্ব নিয়ে বেঁচে আছে ৭হাজার একশ উনচল্লিশ জন সংবাদকর্মী। ২০১৭ সালে আফগানে চরম পন্থীদের হামলায় এমফপি’র প্রধান শাহ মারাইসহ ৭৮ জন সাংবাদিক খুন ও সাড়ে নয় হাজার সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ২০১৮ সালে জামাল খাসোগিসহ ৯৬ জন সাংবাদিক খুন ও প্রায় এগারো হাজার সাংবাদিক নির্যাতিত হয়েছে।
২০১৯ সালে একশ ১৩ জন সাংবাদিক খুন হয়েছে, অসংখ্য সাংবাদিক নির্যাতনে পঙ্গত্ব বরণ করেছে। ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত ছত্রিশ জন সাংবাদিক খুন হয়েছে। বিগত তিন বছরের ইতিহাসে সব থেকে বেশি সাংবাদিক নিহত হওয়া দেশগুলোর মধ্যে সিরিয়া, মেক্সিকো, আফগানিস্থান সব থেকে বিপদজনক স্থানে অবস্থান করছে। বর্তমানে সারা বিশ্বে ৩ হাজার দু’শ ষোল জন সংবাদকর্মীকে মিথ্যা অযুহাতে অন্ধকারাগারে আটক রাখা হয়েছে। তুরস্কে ৪৯ জন, চীনে ৬৩ জন, সিরিয়াতে ৩৩, ইরানে ২৯ জন, ভিয়েতনামে ২১ জন সাংবাদিকে নির্যাতনের পর কারাবন্দী করে রেখেছে। সাংবাদিক নির্যাতন চিত্রে বাংলাদেশে কাজলসহ ৯ জন কারাগারে আছে। চলতি বছরের ছয় মাসে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি সাংবাদিক নির্যাতিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। এখানে পুলিশী হামলা হয়েছে ১০৮টি, বিদ্রোহীরা হামলা করেছে ২৩টি এবং বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে ৬১টি। পুলিশী হামলার ক্যাটগরিতে ৪৫টি শারীরিক, ৩০টি টিয়ারগ্যাস, ৩২টি ক্যামেরা ৩০টি ডোকেমেন্টারী ভাঙচুর, ১৭টি পিপার স্প্রে, ৪৬টি রাবার বুলেট ব্যবহার করেছে। সংবাদ মাধ্যম সিএনএন প্রতিনিধি জিম একোস্টার উপর সরাসরি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আক্রমণ, এনবিসি উপস্থাপক চাকটডের উপর মানুষিক নির্যাতন, প্রেসিডেন্ট বোলসোরানো’র হুমকি, চ্যানেল ওয়ান টিভি’র প্রতিনিধি তেতিয়ানা শিভোকন ইউক্রেনে মাস্ক সংকটের রিপোর্ট করে হামলার শিকার হয়েছে। জার্মান সরকার সাংবাদিক আবদেল কারিমের উপর হামলাকারীদের বিনা বিচারে ছেড়ে দিয়েছে। সাংবাদিকদের সরাসরি হত্যার হুমকি দিয়েছে চেচনিয়ার প্রেসিডেন্ট রামজান কেদরভ। এই সব তামাম দুনিয়ার মানুষ অবলোপন করেছে।
৩। ফিরে দেখা বাংলাদেশ। প্রয়োজনের খাতিরে গুরুত্বের সাথে গণমাধ্যমকে যতই রাষ্ট্রের “ফোর্থ এস্টেট” বলা হোক, বাস্তব চিত্র তার উল্টো। ২০২০ সাল করোনা ভাইরাসে ক্ষতবিক্ষত বিশ্ব, এই পরিস্থিতি হতে বাংলাদেশ বাদ পড়েনি। ভয়ঙ্কর মরণব্যাধি, বিশ্ব আতঙ্ক করোনা। তবুও মহামারীর খবর সংগ্রহের কাজে সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করছে গণমাধ্যমকর্মী, সাংবাদিকরা।
করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে অগণিত সাংবাদিক সহযোদ্ধা পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। প্রতিকুল অবস্থার মধ্যেও সাংবাদিকরা পেশার সাথে বেঈমানী করেনি, দায়িত্ব এড়িয়ে যায়নি।
মৃত্যুকে তুচ্ছ করে জীবনের ঝুকি নিয়ে কোভিড-১৯ মোকাবেলা করছে। দুঃখজনক এতো কিছুর পরেও সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠান হতে গণমাধ্যম কর্মীরা কোন সাহায্য সহযোগিতা সুরক্ষা পায়নি। যে কারণে আমাদের দেশে ২৮৪ জন সংবাদকর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়েছে । এর মধ্যে সুস্থ হয়েছে ৯৩ জন মাত্র। এই যুদ্ধে হুমায়ন কবির খোকনসহ ৪জন সহযোদ্ধাকে চিরদিনের মতো হারিয়েছি। এই মহামারী যুদ্ধে সারা বিশ্বে ১৮৭ জন সাংবাদিক বন্ধুকে হারিয়েছি।
সংকট মোকাবেলায় দায়িত্ব পালনকালে চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, প্রশাসন-পুলিশ ও প্রজাতন্ত্রের সকল কর্মকর্তা, কর্মচারী ঝুঁকি ভাতা পাবে। আর করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা গেলে পরিবারের সদস্যরা পাবে বিশেষ অনুদান, সুযোগ সুবিধা। সাথে থাকবে বীমার ব্যবস্থা। সরকারি চাকুরেদের উৎসাহ উদ্দীপনা বাড়াতে খোদ প্রধানমন্ত্রী প্রণোদনা ঘোষনা করেছেন।
যোগ্য যুগোপযোগী পদক্ষেপের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে সাধুবাদ ও ধন্যবাদ জানাই। দেশে একজন মানুষও করোনায় মারা না যাক সেটাই কামনা করি। সংবাদকর্মী হিসেবে ভাবছি, দেশের এই মহাসংকট মোকাবেলায় করোনা যুদ্ধে সাংবাদিকরা কি কিছু পেয়েছে ? তাদের কি সরকারি বেসরকারি ভাবে নূন্যতম সুযোগ সুবিধা নিরাপত্তা সরকার দিয়েছে ? এই কঠিন সময়ে সরকার ফোর্থ এস্টেটের প্রতি একটুও সমনীয় হয়েছে? সান্তনার ভাষাটুকু জানাতে পেরেছে? সাংবাদিকদের বিন্দু পরিমান সহযোগীতা করেছে এমন সত্য বলার সৎ সাহস আমাদের সরকার, দায়িত্বে থাকা কর্তা বাবুদের নেই। আমাদের দেশে গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ক্ষমতাসীন সরকারগুলোর বড়ই অভাব। এজন্যই দেশে দুর্নীতিবাজ চাটুকার বেষ্টিত শক্ত বেস্টনীতে থাকা সরকারগুলো কখনো গণমাধ্যম বান্ধব হয়ে উঠতে পারেনি। যে দেশে কুকুর বিড়ালকে আঘাত করলে বিচার হয় কিন্তু প্রকাশ্যে সাংবাদিককে নির্মমভাবে হত্যা করলেও তার বিচার হয়না। এখনো কোন সরকারের আমলেই বিচার ব্যবস্থা সুষ্ঠু বিচারের নজির প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। সেই দেশে কেন বলবো সুশাসন প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ? গণতন্ত্রের সুবাতাস বইছে ? এমন সত্য গোপনের দায় আগামী প্রজন্ম আমাকে কখনো ক্ষমা করবে না, তাই সত্যটি জানিয়ে আমার মরণ কাম্য।
যে সব সরকার দেশের মানুষের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দিতে পারে না, জাতির নিরাপত্তা দিতে পারে না, যাদের কাছে স্বাধীনতা অরক্ষিত। তাদের কাছে সাংবাদিক গণমাধ্যম কখনো সম্মানিত হতে পারে না। দেশে ছদ্দবেশে লুকিয়ে থাকা এরাই অপশক্তি। আমাদের শত্রু।
৪। শস্য-শ্যামলে ঘেরা গ্রামের পর গ্রাম, নদীমাতৃক পৃথিবীর বড় ব-দ্বীপের নাম বাংলাদেশ। প্রজা বলতে গ্রামের কৃষক শ্রমিক দিনমজুর। শহর তেমন চোখে পড়ে না হাতে গুণা মাত্র। তাই গ্রামের ঘটনাগুলো সংবাদকর্মীর পাঠানো প্রতিবেদনটি ক্ষুধার্ত মিডিয়ার খোরাকী। প্রতিকুলতার মাঝে অক্লান্তশ্রমে কাঙ্গাল হরিনাথ, মোনাজাত উদ্দীনরা কালে-কালে প্রামীণ সাংবাদিকতাকে অলংকৃত করেছেন। এইজন্য গ্রামীন সংবাদ কর্মীর গুরুত্ব অনুধাবন করে গণমাধ্যমের বিজ্ঞ জনেরা বলে থাকে, মফস্বলের সাংবাদিক গণমাধ্যমের প্রাণ। মফস্বলের একজন সংবাদকর্মীকে সংবাদ সংগ্রহের জন্য নিত্য ছুটে চলতে হয় গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে।
গ্রামীণ মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, চাওয়া-পাওয়া, বঞ্চনা-অধিকার, অভাব-অনটন খবরের পিছনে লুকিয়ে থাকা জানা অজানা কথা ও কাহিনী সবকিছু মালা গেঁথে খবর করে তুলে আনে মফস্বলের গণমাধ্যম কর্মীরা। গ্রামীণ সাংবাদিকের দৃষ্টি এড়ায় না, বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনজীবনের সমস্যা-সম্ভবনা ও মানবিক অনুধাবনের নানা দিকগুলো।
এদের পর্যালোচনা লেখনী প্রতিবেদনে অণুবীক্ষণের ন্যায় উঠে আসে অপশক্তির বিরুদ্ধে বাংলার অকৃত্রিম চিত্র। তবুও কেন মফস্বলের সাংবাদিক বন্ধুরা সরকারের গণমাধ্যম নীতি মালায় স্থান পায়না ? শহরে নকল ইংরেজদের ওয়েজ বোর্ডে গ্রামীণ সাংবাদিকদের কথা বলা হয়না। মফস্বলের সাংবাদিকতা এযুগের আধা বাঙালি বাবুদের কাছে গুরুত্বহীন। প্রতিষ্ঠান তাদের সুখ-দুঃখের খবর রাখে না, নূন্যতম মজুরী বেতন-ভাতা দেয়না। দিনের পর দিন মাস পেরিয়ে বছর গড়ালেও মফস্বলে কর্মরত বঞ্চিত গণমাধ্যম কর্মীদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না।
তাদের জ্বালা-যন্ত্রণা, অভাব-অনটনের খোঁজ রাখে না। মুখে যায় বলুন, সরকার-প্রতিষ্ঠান থেকে মিথ্যা সান্তনা ছাড়া মফস্বলের সাংবাদিকরা আজও কিছু পায়নি। দায়িত্বের জায়গা হতে এমন সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলতে পারি, প্রাগৈতিহাসিক যুগের অবসান হলেও এখনো পর্যন্ত বর্বরতা অন্ধকার থেকে এই সমাজ রাষ্ট্র বেরিয়ে আসতে পারেনি।
যতদিন কর্মের অবমূল্যায়ন হবে ততদিন কারণে-অকারণে সরকারের পরিবর্তন হবে, নতুন সরকার আসবে কিন্তু উন্নয়ন-অধিকার নিশ্চিত অসম্ভব। সরকারের দীর্ঘ ক্ষমতা, দেশ-জাতির উন্নয়নে মফস্বল সাংবাদিকদের ভূমিকা অপূরনীয়। আর্থ মিলারের সাথে একমত হয়ে আরো দাবি করে বলতে পারি, সংবাদমাধ্যম মানুষের কন্ঠ। সুন্দর পৃথিবীর অগ্রযাত্রায় সময়োপযোগী একমাত্র নিরাপদ তরী গণমাধ্যম। বিষয়টি সরকার ও দায়িত্বশীল কর্তাদের এখনি ভাবতে হবে। পেশা না হলেও নেশার টানে মফস্বলে কর্মরত গণমাধ্যম বন্ধুদের সাবধান-সচেতন হতে হবে। হতে হবে আরো দায়িত্বশীল ও ঐক্যবদ্ধ।
আলমগীর মতিন চৌধুরী, সাবেক সভাপতি- প্রেসক্লাব চৌগাছা, যশোর।
সম্পাদক – বাংলার দৈনিক
ই-মেইল- [email protected]