বার্তাবিডি২৪ ডেস্ক নিউজ: সংঘাতের পথে হাঁটছে চলমান রাজনীতি। রাজনৈতিক সংকট সমাধানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ওপর সংলাপে বসার তাগিদ থাকলেও কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই তাদের।
আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে মাঠের রাজনৈতিক কর্মসূচী ও কর্ম কান্ডে মনে হচ্ছে, সংঘাতের পথেই হাঁটছে দেশের সবচেযে বড় রাজনৈতিক দল ০২টি আওয়ানীলীগ ও বিএনপি।
যার যার অবস্থানে অনড় থেকে রাজপথেই নিজেদের শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হচ্ছে তারা ।
মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বলছে, আলোচনার এজেন্ডা হতে হবে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সর কার নিয়ে।
অপরদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ চাইছে, ভোটগ্রহণ সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচিত দলীয় সরকারের অধীনেই হতে হবে।
আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য আর ২ মাস যখন বাকি, তখন এই দুই বড় দলের মধ্যে বিদ্যমান অচলা বস্থা ভাঙার জন্য আবারও আলোচনায় বসার কথা সামনে এসেছে।
কিন্তু এ ক্ষেত্রে কার্যকর উদ্যোগ নেই কোনো পক্ষ থেকেই। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সংলাপের পথ একেবারে বন্ধ, তা বলছে না। তবে তারা নিজেরা সংলাপের দায়িত্ব নিতে রাজি নয়।
বরং ২৮ অক্টোবর রাজধানী ঢাকায় পালটাপালটি সমাবে শের মধ্য দিয়ে নিজেদের শক্তিমত্তার বিষয়টি জানান দিতে চায় দল দুটি। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সবার প্রশ্ন তা হলে কী রাজপথেই ফয়সালা হবে।
যদিও চলমান রাজনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণে অর্থবহ সংলাপই শেষ ভরসা বলে মনে করছেন রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজসহ দেশের বিশিষ্টজনরা।
তাদের মতে, সব দলের অংশগ্রহণে আগামীতে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে আলোচনার টেবিলে বসা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।
আর এ উদ্যোগ আওয়ামী লীগের তরফ থেকেই নিতে হবে। এক্ষেত্রে ‘শর্ত’ জুড়ে দিলে এই সংলাপ দিনশেষে অর্থহীনই হবে।
বাংলাদেশে একটি বিশ্বাসযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক ও সহিংস তামুক্ত জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোকে অর্থবহ সংলাপে বসতে বলেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচনি পর্যবেক্ষক দলও।
ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউট (এনডিআই) এবং ইন্টা রন্যা শনাল রিপাবলি কান ইনস্টিটিউটের (আইআর আই) সমন্বয়ে গঠিত এ প্রতিনি ধিদলের সদস্যরা সম্প্রতি বাংলা দেশ সফর করেন।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সরকার, রাজনৈতিক দল, নির্বাচন কমিশনসহ অংশীজনদের পাঁচটি সুপারিশ করে ন তারা। এর মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অর্থবহ সংলাপের বিষয় টি বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
কিছু দিন আগে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে দ্য হাঙ্গার প্রজেক্টের উদ্যোগে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন’র সহযো গিতায় অনুষ্ঠিত এক আলোচনা সভায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাসহ বিশিষ্টজনরাও বলেছেন, জাতীয় নির্বাচন ঘিরে সৃষ্ট সংকট সমাধানে সংলাপের বিকল্প নেই। নিজেদের সমস্যা নিজেদেরই সমাধান করতে হবে।
সংলাপ হলে পারস্পরিক আস্থা রাখতে হবে, ছাড় দেওয়ার মানসিকতা রাখতে হবে। সেখানে সুনির্দিষ্ট কিছু এজেন্ডা নির্ধারণ করতে হবে, যাতে আমরা ভবিষ্যতে সংকট এড়াতে পারি। আলোচনার টেবিলে বসেই সমস্যার সমাধান হওয়া দরকার বলেও এ সময় মতামত ব্যক্ত করেন তারা।
বিভিন্ন সময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, মাঠের বিরোধী দল বিএনপি, জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি সহ নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও সংকট সমাধানে সংলাপে বসার তাগিদ দিয়েছে।
নির্বাচন কমিশনও দুই বড় দলকে আলোচনার টেবিলে বসার অনুরোধ জানিয়েছে। কেউ শর্ত জুড়ে দিয়ে আবার কেউ শর্ত ছাড়াই এক টেবিলে বসার পরামর্শ দিয়েছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে।
প্রভাবশালী বিভিন্ন দেশ, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর প্রতিনিধিরাও নির্বাচন সামনে রেখে চলমান সংকট আরও প্রকট হওয়ার আগেই সংলাপের মাধ্যমে সমাধানের পথে হাঁটার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে এক টেবিলে বসতে বলেছে।
মূলত: ২টি বড় দলই চলছে উলটো পথে। তারা যার যার অবস্থানে অনড়, কেউ কাউকে ছাড় দিতেওনারাজ।
এ বিষয়ে বিশিষ্ট আইনজীবী, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও গণফো রাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেন, পরিস্থিতি ক্রমেই যেদিকে যাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে সমাধান না হলে দেশের পরিস্থিতি সংঘাতময় হয়ে উঠবে।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণে সংলাপই একমাত্র সমাধান। তিনি আরও বলেন, যারা সরকারে রয়েছে, তাদের দায়িত্ব বেশি। তাই সরকারি দলকেই এক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে।
আন্তরিকতা নিয়ে এক টেবিলে আলোচনার জন্য বসলে যে কোনো সমস্যার সমাধান সম্ভব।
বড় দুদলের এই বিপরীতমুখী অবস্থান সত্ত্বেও আলোচনার টেবিলে বসে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান চায় জাতীয় সংস দের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি।
দলটির চেয়ারম্যান ও জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় উপনে তা জিএম কাদের এমপি বলেন, আম রা সব সময় বলেছি, বহুবার বলেছি-আলোচনায় বসে সংক টের সমাধান বের করা জরুরি।
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, পালটা পালটি কর্মসূচিতে কি হচ্ছে বলা যাচ্ছে না। তবে আলোচনার পথে আসা উচিত।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কর্নেল (অব.) ফারুক খান বলেন, আলোচনায় বসার আগেই যদি আপনি শর্ত জুড়ে দেন, তাহলে কি নিয়ে আলোচনা হবে।
তিনি আরও বলেন, সংবিধান অনুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচ নের আয়োজন করতে আওয়ামী লীগ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মো. হারুনুর রশীদ বলেন, আওয়া মী লীগ বারবার প্রমাণ করেছে তাদের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়।
তাই আমরা বর্তমান সরকারের পদত্যাগসহ নির্দলীয় নিরপে ক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চাই।
বিএনপির সঙ্গে আন্দোলনে থাকা নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে অনুষ্ঠিত সংলাপে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, আমার ওপর আস্থা রাখুন, নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তার সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেননি।
গণফোরামের একাংশের সাধারণ সম্পাদ অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাওয়া আর না যাওয়া একই কথা।
তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী যদি গো ধরে থাকেন, তাহলে রাজনৈতিক সংকট আরও তীব্র হবে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে এর দায় তাকেই নিতে হবে।
এ নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীয় বড়ুয়া বলেন, শর্ত ছাড়া সংলাপে বসতে হবে বিএনপিকে।
তারা শর্ত জুড়ে দিয়েছে এ কারণেই যে, তারা জানে এটা আওয়ামী লীগের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগও মানবে না, সংলাপও হবে না।
আর তখন তারা নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করবে। আওয়ামী লীগও এটা মোকাবিলার চেষ্টা করবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার এ প্রসঙ্গে বলেন, স্বাধীনতার পর ৫২ বছর পেরিয়ে গেছে। এ সময়ের মধ্যেও আমরা আমাদের গণতান্ত্রিক ও নির্বাচনি ব্যবস্থাকে কার্যকর করতে পারিনি।
তিনি আরও বলেন, বড় দুটো দলের মধ্যে যে সংলাপ হতে হবে সে বিষয়ে কোনো বিতর্ক নেই।
নির্বাচনে পরাজিত দলের নেতাকর্মীদের জীবন-জীবিকা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে ব্যাপারেও রাজনৈতিক দলগু লোর ঐকমত্য থাকা দরকার।
মূলত নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়েই চলমান রাজ নৈতিক পরিস্থিতি দিন দিন উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। দ্বাদশ জাতী য় সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘনিয়ে এসেছে।
সংবিধান অনুযায়ী, ১ নভেম্বর থেকে ২৯ জানুয়ারির মধ্যে সংসদ নির্বাচন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ২২ অক্টোবর একাদশ জাতীয় সংসদের শেষ অধিবেশন বসে। ২ নভেম্বর পর্যন্ত এই অধিবেশন চলার কথা।
এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠন করা হবে নির্বা চন কালীন সরকার।
এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও সদিচ্ছা থাকা দরকার।
সর্বশেষ যতদূর জানাযায়,আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতারা প্রকাশ্যে এড়িয়ে গেলেও সংকট নিরসনে আলোচনায় বসতে রাজি। কিন্তু কোনো পক্ষই ছাড় দিতে রাজি নয়।
সংলাপে বসতে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে শর্ত। বিপত্তি এখানেই। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ মনে কর ছেন, নির্বাচনের আগে বিরোধীদের সঙ্গে আলাপ-আলো চনার প্রয়োজন হতে পারে।
এমন একটি তাগিদ হয়তো একপর্যায়ে আসতে পারে। কিন্তু শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন-এ দুটি বিষয়ে আওয়ামী লীগ সংলাপ করতে রাজি নয়।
কারণ সংলাপে এ দুটি বিষয় এলেই রাজনৈতিকভাবে আও য়ামী লীগের এক ধরনের পরাজয় হয়ে যাবে।
ক্ষমতাসীন দলের কারও কারও মতে, শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন-এমন বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নিয়ে সংলাপ করা হলে ভোটের আগেই হেরে যাবে আওয়ামী লীগ।
তাই, বিএনপিও তার অবস্থানে অনড়, তারা শেখ হাসি নার নেতৃত্বাধীন দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না। তারা রাজপথেই দাবি আদায় করতে চায়।
আওয়ামী লীগও বিএনপিকে মোকাবিলায় মাঠে থাকবে, সেই নির্বাচনের প্রস্তুতি নেবে বলে ঘোষণা দিয়েছে।