মুহা: জিললুর রহমান, সাতক্ষীরা:
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসন ও জেলা কৃষি বিভাগের সমন্বয়ে প্রকাশিত আম ক্যালেন্ডারের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে জেলার প্রান্তিক পর্যায়ের আম চাষীরা। গোপালভোগ ও গোবিন্দভোগ আম ইতিমধ্যে গাছে পাকতে শুরু করলেও প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞার কারণে তা ভাঙতে পারছেন না চাষীরা। ফলে অনেক স্থানে পাকা আম গাছ থেকে পড়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে মোটা অংকের টাকা বিনিয়োগ করে বাগান কিনে ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন অনেক আম চাষী।

জেলায় আম চাষের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভৌগলিক কারণে দেশে প্রথম আম পাকে সাতক্ষীরায়। ফলে দেশের অন্য জেলার তুলনায় সাতক্ষীরার আম আগেভাগেই বাজারে উঠে। এত করে চাষীর দামও একটু বেশি পেয়ে থাকেন। কিন্তু জেলা প্রশাসন ও জেলা কৃষি বিভাগ প্রতিবছর আম ভাঙার তারিখ পেছানোর কারনে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন তারা।

গেল দুই বছরের ব্যবধানে চলতি বছর গোবিন্দভোগ ও আ¤্রপালি প্রজাতির আম ভাঙতে পেছানো হয়েছে ১০/১১ দিন। ২০২১ সালে ২ মে গোপালভোগ ও গোবিন্দভোগ প্রজাতির আম ভাঙার অনুমতি দেওয়া হলেও দুই বছরের ব্যবধানে এই আম ভাঙতে ১০দিন বৃদ্ধি করে ১২ মে করেছে জেলা প্রশাসন। আর আ¤্রপালি আম ভাঙতে ১১দিন বৃদ্ধি করে ৪জুনের পরিবর্তে করা হয়েছে ১৫জুন। ফলে গাছে আগেভাগেই আম পাকলেও ভাঙতে পারছেন না চাষীরা। এজন্য আম ক্যালেন্ডার বাতিল করে জনসচেতনতা ও বাজার মনিটরিং এর উপরে গুরুত্ব দিতে জেলা প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ করেছেন জেলার আমচাষীরা।

জেলা কৃষিবিভাগ সূত্রে জানা যায়, চলতি বছর জেলার চার হাজার ১১৫ হেক্টর জমিতে আম চাষ করেছেন ১৩ হাজার ১০০ চাষি। এর মধ্যে সদর উপজেলায় এক হাজার ২৩৫ হেক্টর, কলারোয়ায় ৬৫৫ হেক্টর, তালায় ৭১৫ হেক্টর, দেবহাটায় ৩৭০ হেক্টর, কালিগঞ্জে ৮৩৫ হেক্টর, আশাশুনিতে ১৪৫ হেক্টর ও শ্যামনগরের ১৬০ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে। আর, উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৫ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন।

এদিকে গত ১৬ এপ্রিল সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসকের সম্মেলনে কক্ষে নিরাপদ আম বাজারজাতকরণ বিষয়ক এক মতবিনিময় সভায় ১২ মে থেকে সাতক্ষীরার গোবিন্দভোগ, গোপালভোগ, বোম্বাই, গোলাপঘাস, বৈশাখীসহ আরও কয়েকটি প্রজাতির আম, ২৫ মে হিমসাগর, ১ জুন ল্যাংড়া ও ১৫ জুন আ¤্রপালি ভাঙার অনুমতি দেয় জেলা প্রশাসন।

অথচ, আমের রাজধানী হিসেবে পরিচিত চাঁপাইনবাবগঞ্জে গত কয়েক বছর ধরে কোন প্রকার আম ক্যালেন্ডার প্রকাশ করা হয়না। আমের পাক ধরলে আম চাষী ও ব্যবসায়ীরা তাদের সুবিধামতো গাছ থেকে ফল সংগ্রহ করে তা বাজারজাত করেন। এক্ষেত্রে সহযোগীতা করেন সেখানকার সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ও কৃষিবিভাগ। সেখানে সাতক্ষীরার মতো জায়গায় আম ক্যালেন্ডার করা কতটুকু যুক্তিসংগত সেটা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে।

তবে সাতক্ষীরা জেলা কৃষিবিভাগ বলছে, প্রকাশিত আম ক্যালেন্ডার নামমাত্র করা। নির্ধারিত তারিখের আগে যদি কোন বাগানে আম পাকে, তাহলে ওই এলাকার সংশ্লিষ্ট কৃষি কর্মকর্তার মাধ্যমে উপজেলা প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে বাজারজাত করতে পারবেন তারা। তবে, অগ্রিম আম পাকলে সেক্ষেত্রে কৃষিবিভাগ থেকে কোন নির্দেশনা পাননি বলে দাবি করেন একাধিক আম ব্যবসায়ী ও চাষীরা।

এ প্রসঙ্গে সাতক্ষীরার সদর উপজেলার আম ব্যবসায়ী সুফিয়ান জানান, প্রতিবছর প্রায় ৬০ বিঘা জমির বাগানে আম চাষ করেন তিনি। তবে জেলা প্রশাসন ও জেলা কৃষিবিভাগের প্রকাশিত আম ক্যালেন্ডারের কারণে প্রতিবছর তার ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। তবে গেল কয়েক বছরের চেয়ে এবার ক্ষতির পরিমাণটা অনেংকাংশে বেশি হবে বলে জানান তিনি।

শফিকুল ইসলাম নামে অপর এক আম ব্যবসায়ী জানান, কয়েক লাখ টাকা দিয়ে এবার ৪০টি আম বাগান কিনেছেন তিনি। এর মধ্যে ৫টা বাগানের গোবিন্দভোগ প্রজাতির আম পাক ধরলেও প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞার কারনে তা ভাঙতে পারছেন না। এতে করে, আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন বলে দাবি করেন তিনি।

তিনি বলেন, আমাদের হাতে জেলা প্রশাসন থেকে একটা লিফলেট দেওয়া হয়। সেখানে, ১২ মে থেকে গোবিন্দভোগ প্রজাতির আম, ২৫ মে হিমসাগর, ১ জুন ল্যাংড়া ও ১৫ জুন আ¤্রপালি ভাঙার জন্য বলা হয়।

কিন্তু নির্ধারিত তারিখের আগে আম পাক ধরলে করণীয় কী সেই সম্পর্কিত বিষয়ে জেলা প্রশাসনের দেয়া ওই লিফলেটে কোনকিছু লেখা ছিলোনা। তাছাড়া কৃষিবিভাগ আমাদেরকে কোন লিফলেট দেয়নি। তবে, কৃষিবিভাগ যদি বলে থাকে আমাদেরকে আম পাকা সম্পর্কিত কোন নির্দেশনার লিফলেট দিয়েছে তাহলে সেটা তাদের ভুল হবে।

জেলার একাধিক আম চাষী ও ব্যবসায়ীরা আম ক্যালেন্ডার নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ১২ মে থেকে গোবিন্দভোগ প্রজাতির আম ভাঙার অনুমতি দেয় জেলা প্রশাসন। তবে, ওই তারিখে অধিকাংশ বাগানে হিমসাগর আমের পাক ধরবে। আর গোবিন্দভোগ প্রজাতির অধিকাংশ আমের কোন অস্তিত্ব থাকবে না। এভাবে আম ক্যালেন্ডার করে চাষী-ব্যবসায়ীদের ক্ষতি করার অধিকার কী কারও আছে? বলে প্রশ্ন রাখেন তারা। এসময় তারা আরও বলেন, এভাবে আম ক্যালেন্ডার না করে প্রশাসনের উচিত বাজার মনিটরিং করা। তৃণমূলের চাষীদের সাথে মতোবিনিময় ও জনসচেতনতা করা। যারা অপরিপক্ক আম বাজারজাত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। কিন্তু মুষ্টিমেয় কয়েকজন াসাধু ব্যবসায়ির জন্য সবাই ক্ষতিগ্রস্থ হবে এটা ঠিক না।

খোজঁ নিয়ে জানা যায়, দেশের অধিকাংশ জায়গায় আম ক্যালেন্ডার প্রকাশ না করা হলেও সেক্ষেত্রে ভিন্ন সাতক্ষীরা। একমাত্র ল্যাংড়া আম ব্যতিত প্রতিবছর আম ভাঙার তারিখ পেছানো হয় এ জেলাতে। এতেকরে, দুর্যোগ কবলিত এই অঞ্চলের আম চাষী ও ব্যবসায়ী আর্থিকভাবে ক্ষতির শিকার হন। গত কয়েক বছরের ব্যবধানে এবার বিভিন্ন প্রজাতির আম ভাঙার তারিখ পেছানো হয়েছে ১০ দিন।

এতে করে, সাতক্ষীরা থেকে প্রতিবছর যে আম ইউরোপের বাজারসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হতো। এবার বিশ্ব বাজারে সাতক্ষীরার আম রপ্তানিতে অনিশ্চিয়তা দেখা দিয়েছে। মূলত, সাতক্ষীরার আম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে বিভিন্ন এজেন্ট। কেননা, আম ভাঙ্গার যে ক্যালেন্ডার জেলা প্রশাসন প্রকাশ করেছে সেই সময়ে দেশের অন্যান্য জায়গার আম পাক ধরে। আর সাতক্ষীরার চেয়ে বাজারদর কম ও পরিবহন খরচ কম হওয়াতে ওই সমস্ত এলাকায় ঝুঁকছেন এজেন্টরা। এতে করে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে সাতক্ষীরার আম চাষীরা।

সাতক্ষীরার আম বাজারজাতকরণে প্রকাশিত আম ক্যালেন্ডার মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে জেলার চাষী ও ব্যবসায়ীদের মাঝে। যে সময়ে আম ক্যালেন্ডারে আম ভাঙার অনুমতি দেয়া হয়েছে সে সময়ে একাধিক প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্ভাবনা রয়েছে।

অগামী ১৩ মে নাগাদ ঘূর্ণিঝড় মোচা বাংলাদেশ উপকুলে আগাত আনতে পারে। যদি তাই হয় তাহলে সাতক্ষীরায় কোন বাগানে আম থাকবে না।

এ প্রসঙ্গে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ন কবিরের সাথে যোগাযোগ করলেও কল রিভিভ না হওয়াতে বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।

এব্যাপারে সাতক্ষীরা জেলা কৃষি স¤প্রসারণ (খামারবাড়ি) অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আম ক্যালেন্ডারের কারণে কোন চাষী ও ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেনা। চাষী-ব্যবসায়ীরা দাবি করছেন তারা ক্ষতিগ্রস্ত প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্ধারিত তারিখের আগে যদি কোন বাগানে আম পাকে, তাহলে ওই এলাকার সংশ্লিষ্ট কৃষি কর্মকর্তার মাধ্যমে উপজেলা প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে বাজারজাত করতে পারবেন।

ভৌগলিক কারণে সাতক্ষীরার আম আগাম পাকে অথচ প্রতিবছর আম ভাঙার তারিখ পেছানো হয়, তবে চাপাইনবাবগঞ্জে আম ক্যালেন্ডার হয়না, তাহলে সাতক্ষীরাতে কেন? প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আম ক্যালেন্ডারটি না করলে নই বলে করা।

মূলত জেলায় কিছু অসাধু ব্যবসায়ী রয়েছেন যারা অপরিপক্ক অবস্থায় আম ভেঙে বাজারজাত করে। একারণে জেলা প্রশাসন ও জেলা কৃষিবিভাগের সমন্বয়ে আম ভাঙার একটি প্রাথমিক তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। যাতে অসাধু ব্যবসায়ীরা অপরিপক্ব আম বাজারজাত করতে না পারেন।

তিনি আরো বলেন, ইতিমধ্যে জেলা বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় ৬০ হাজার কেজি অপরিপক্ক আম জব্দ করে বিনষ্ট করা হয়েছে। এভাবে প্রায় প্রতিদিনই জেলার কোথাও না কোথাও ক্যৗামিকেলে পাকানো অপরিপক্ক আম জব্দ করছে স্থানীয় প্রশাসন। মূলত বিষ ও ক্যামিকেলমুক্ত আম যাতে ব্যবসায়িরা বাজারজাত করতে পারেন তার জন্য এই আম ক্যালেন্ডার।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *