আফজাল হোসেন চাঁদ, ঝিকরগাছা : পবিত্র রমজান ও ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ২৩ মার্চ থেকে আগামী ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত স্কুল-কলেজ বন্ধের সিদ্ধান্ত থাকলেও সরকারি নীতিমালা উপেক্ষা করে যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলায় চলছে রমরমা কোচিং বাণিজ্য। আর এই কোচিং বাণিজ্যের চক্করে পড়ে ইভটিজিংয়ের শিকার হয়ে সোমবার (২৭ মার্চ) অনি রায় (১৩) নামের এক শিক্ষার্থী, স্কুলের কোচিং ক্লাস থেকে বাড়ী ফিরেই আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

সে ঝিকরগাছা বদরুদ্দীন মুসলিম (বিএম) হাইস্কুলের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী ও পৌরসদরের ৪নং ওয়ার্ড হাসপাতাল রোডের মিস্ত্রীপাড়ার বাসিন্দা কুয়েত প্রবাসী গৌতম রায়ের মেয়ে। সরকারি নীতিমালা উপেক্ষা করে ঝিকরগাছা বদরুদ্দীন মুসলিম (বিএম) হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের একক সিদ্ধান্তে কোচিং বাণিজ্যের মাধ্যমে যে ঘটনা ঘটলো এটার বিষয়ে তদন্ত পূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দাবি জানিয়েছেন এলাকার সচেতন মহল।

মামলার বাদি অনির মা কনিকা রায়ের এজাহার সূত্রে জানা যায়, তার মেয়ে সোমবার (২৭ মার্চ) সকাল ১০টার দিকে কোচিং শেষ করে ঝিকরগাছা বিএম হাইস্কুলের গেটের উত্তর-পূর্ব কোণে হাইস্কুলের নির্মাণাধীন দোকানের সামনে পৌছাইলে আসামীরা তার মেয়েকে দাড়াতে বলে। কিন্তু অনি রায় না দাড়ালে আটককৃত আসামী মেহেদী হাসান তামীম তার হাত ধরে টান দেয়।

এসময় ইভটিজিংকারিরা তার মেয়েকে বিভিন্ন রকম কু-রুচিপূর্ণ অশ্লীল ও সম্ভ্রম হানিমুলক কথাবার্তা বলে। যা অনি রায় এর বান্ধবী লামিয়া ইয়াসমিন সেতু, ওরিশা বিনতে কবীর ও সৈয়দ সুমাইয়া সিমরান অবগত। প্রকাশ্য স্থানে আসামীদের উক্ত কার্যকালাপ ও আচরণে অনি রায় কান্নাকাটি করতে করতে বাড়িতে যায়। এসময় অনির মা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলে সে কোন কিছু না বলে নিজ ঘরে প্রবেশ করে। এর কিছুক্ষন পর মেয়েকে ডাকাডাকি করলেও কোন সাড়া না মেলায় ছেলে শুভম রায় অর্ঘ্যকে ডাক দেয়। অর্ঘ্য বাড়ীর বাইরের দেয়ালের সানসেটের উপর উঠিয়া ভেন্টিলেটর দিয়ে দেখতে পায় তার বোন মায়ের শাড়ি দিয়া সিলিং ফ্যানের সাথে গলায় ফাঁস দিয়া ঝুলে আছে।

পরে তাদের ডাক চিৎকারে ঘরের দরজা ভেঙ্গে স্থানীয়দের সহযোগিতায় ঝিকরগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তার মৃত্যু ঘোষনা করেন।

এই আত্মহত্যাকে কেন্দ্র করে লাশের ময়নাতদন্ত শেষে মঙ্গলবার (২৮ মার্চ) দুপুর ৩টায় অনির লাশ নিয়ে সহপাঠি ও এলাকাবসীরা উপজেলা মোড়স্থ যশোর-বেনাপোল মহাসড়কে ঘন্টাব্যাপী অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে। প্রতিবাদ সমাবেশে অনিকে উত্যক্তকারী, আত্মহত্যায় প্ররোচনা দান কারীদের ফাঁসির দাবী জানানো হয়।

এছাড়াও স্কুল কতৃপক্ষের নীরব ভূমিকারও তীব্র নিন্দা জানান বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারী প্রতিটা মানুষ। অপরদিকে থানা পুলিশের পক্ষ হতে প্রথমে অপমৃত্যুর মামলা নেওয়া হয় এবং পরবর্তীতে ঘটনার বিষয়ে অনি রায়ের আত্মহত্যার ঘটনায় মা কনিকা রায় বাদী হয়ে ২জনকে এজাহার ভুক্তসহ অজ্ঞাতনামা আরও ২/৩জনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা হয়েছে। মামলা নং-২৪, তাং ২৯/০৩/২০২৩ ইং। ঘটনার বিষয়ে এড়িয়ে যেতে প্রথমে স্কুলের প্রধান শিক্ষক অনি রায়ের পরিবারের পাশে দাড়ানি বলে অভিযোগ উঠলে প্রধান শিক্ষক তড়িঘড়ি করে নিজেকে বাচাঁতে পরিবারের পাশে দাড়িয়েছেন এবং এলাকার মানুষের চাপে পড়ে ঘটনার বিষয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে বুধবার স্কুলের মুল ফটকে শোক ব্যানার লাগিয়েছেন। কিন্তু এই ব্যানারের মাধ্যমে সন্তান হারা পরিবার কি তাদের মেয়েকে ফিরে পাবে ?

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক অভিভাবক জানিয়েছেন, ঝিকরগাছা বদরুদ্দীন মুসলিম (বিএম) হাইস্কুলের সকল শিক্ষার্থীদেরকে বাধ্যতামুলক কোচিং করানো হয়। প্রতি শ্রেণিতে একযোগে ৪০ জন শিক্ষার্থীর বেশি শিক্ষার্থী দিয়ে কোচিং পরিচালিত হয়। কোচিং বাণিজ্যে যুক্ত শিক্ষকদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ছেন অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা। যা পরিবারের ওপর বাড়তি আর্থিক চাপ সৃষ্টি করছে এবং এ ব্যয় মেটাতে অভিভাবকরা হিমশিম খাচ্ছেন। কোচিং এর উপজেলা পর্যায়ে ফি দেড়শ টাকার স্থানে ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মাসিক কোচিং ফি ৪শত টাকা এবং ৮ম, ৯ম ও ১০ম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মাসিক কোচিং ফি ৫শত টাকা নিচ্ছে স্কুল কতৃপক্ষ।

তবে সরকারের ২০১২ সালে কোচিং বাণিজ্য বন্ধ নীতিমালা অনুযায়ী উল্লেখ পাওয়া যায়, কোনো শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে কোচিং করাতে পারবেন না। তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানের অনুমতি নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ ১০জন শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়াতে পারবেন। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান প্রধানকে ছাত্রছাত্রীর তালিকা, রোল, নাম ও শ্রেণি উল্লেখ করে জানাতে হবে। নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো শিক্ষক বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গড়ে ওঠা কোনো কোচিং সেন্টারে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত হতে পারবেন না বা নিজে কোনো কোচিং সেন্টারের মালিক হতে পারবেন না বা কোচিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন না।

কোনো শিক্ষক শিক্ষার্থীদের কোচিং-এ উৎসাহিত, উদ্বুদ্ধ বা বাধ্য করতে পারবেন না। অভিভাবকদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠান প্রধান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত সময়ের আগে বা পরে অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা করতে পারবেন। এক্ষেত্রে জেলা পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে দুইশ টাকা এবং উপজেলা ও অন্যান্য এলাকার শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে দেড়শ টাকা নেওয়া যাবে। তবে প্রতিষ্ঠান প্রধান ইচ্ছা করলে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের এই অতিরিক্ত কোচিংয়ের টাকা কমাতে বা মওকুফ করতে পারবেন বলে নীতিমালায় বলা হয়েছে। নীতিমালা অনুযায়ী অতিরিক্ত ক্লাসের ক্ষেত্রে একটি বিষয়ে মাসে কমপক্ষে ১২টি ক্লাস নিতে হবে, প্রতি ক্লাসে সর্বোচ্চ ৪০ জন শিক্ষার্থী অংশ নিতে পারবে।

ঝিকরগাছা বদরুদ্দীন মুসলিম (বিএম) হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক মোঃ আব্দুস সামাদ জানান, কোচিং শেষ হলে ঐ মেয়ে ৩ বান্ধবী মিলে বাহিরে গেছে। ওখানে নাকি সেই বন্ধুর সাথে টিকটক করা নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়েছে। তার সম্পর্ক আছে তামিমের সাথে শোনা গেছে। যে এ্যারেস্ট হয়েছে। সে নাকি একটা থাপ্পড় মেরেছে। তখন স্কুলে এসে ব্যাগ নিয়ে বলছে আমার শরীর খারাপ প্রাইভেট পড়বো না। যেটা আমরা ফুটেজে দেখেছি। ব্যাগ নিয়ে সোজা বাড়ি গিয়ে আত্মহত্যা করেছে। এই হল মূল কাহিনী, এর বাহিরে আর কোনো কাহিনী পাওয়া যায়নি। ঘটনার বিষয় নিয়ে আমরা মানববন্ধন করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের ওসি সাহেব বলল, যেহেতু আসামী ধরা পড়ে গেছে অতএব এখন মানববন্ধন করার দরকার নেই।

এখন আমাদের কাছে প্রশাসন যত তথ্য চাচ্ছে আমরা সেটা দিচ্ছি। অকালে চলে যাবে এমন একটা মেয়ে এটা হবে না। আমরা এটার বিচার চাই। তখন সংবাদকর্মীরা স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত থাকলেও সরকারি নীতিমালা উপেক্ষা করে স্কুলে কোচিং করানোর বিষয়ে তিনি বলেন, কোচিংয়ের নীতিমালা তুমি মনে হয় জানো না। এই কোচিং সেই কোচিং না। এই কোচিংটা হচ্ছে যারা বিভিন্ন বাসা বাড়ি ভাড়া নিয়ে কোচিং করায় না এটা এদের কোচিং। আমাদের স্কুল কেন্দ্রিক কোচিং করানোর জন্য সরকারি নীতিমালা আছে। সেই নীতিমালার আলোকেই আমরা কোচিং করায়। বন্ধের দিনও কোচিং করানো যাবে। কোচিংটা হলো শিক্ষার্থীদের একটা ঘাটতি পূরণের জন্য।

যেমন যশোরের সব প্রতিষ্ঠানই কোচিং করে পুলিশ লাইন, কালেক্টরেট স্কুল, শাহিন স্কুল, আমাদের এমএল স্কুল, গালর্স স্কুল করে, আমরা করি, সম্মিলনী করে, টাওরা করে, পারবাজার করে। এখন শিক্ষার্থীদের এগিয়ে নিয়ে যেতে আমাদের কোচিং করাতে হয়। স্কুলের শিক্ষার্থী মারা যাওয়ার পরেও পরের দিন মঙ্গলবারও স্কুলে কোচিং করানোর বিষয়ে তিনি বলেন, আমার আসতে দেরি হয়েছে বলে স্কুলে কোচিং হয়েছে। তবে সহকারী প্রধান শিক্ষক ছিলো। তার দায়িত্ব ছিলো আমাকে জানিয়ে বন্ধ করে দেওয়া। কিন্তু সে বন্ধ দেয়নি। ভূল তো হয়ই। তবে আমারা আজকে (বুধবার) কোচিং বন্ধ করে দিয়েছি। আগামী সপ্তাহ থেকে আবারও কোচিং চলবে বলে আশা ব্যক্ত করেছেন স্কুলের এই প্রধান শিক্ষক। তবে এমএল স্কুলের বিষয় খোজ খবর নিয়ে জানা গেছে তারা কোচিং বাদে স্বাভাবিক রুটিনে ক্লাস হচ্ছে।

উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার কামরুজ্জামান মোঃ জাহাঙ্গীর হুসাইন মিয়া বলেন, স্কুলের শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার বিষয়ে আমি আগে জানতাম না। স্থানীয় একজন সাংবাদিক আমাকে ফোন দিয়ে জানান বিষয়টি। পরবর্তীতে আমি জেলা শিক্ষা অফিসার কে অবহিত করি। বুধবারের পত্রিকাতে দেখি যে ইভটিজিংয়ের শিকার হয়েছে এবং এই বিষয়ে মঙ্গলবার বিক্ষোভ হয়েছে। স্কুলে কোচিং করানোর বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, বর্তমানে সরকারি ভাবে স্কুল বন্ধ। তারা যে স্কুলে কোচিং করাচ্ছে সেটার বিষয়ে আমাদের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে করতে হয়। কিন্তু তারা সেটা করিনি। তারা তাদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান নিজস্ব সুবিধার জন্য করে থাকে। তবে ওখানে যে কোচিং চলছে সেটা আমার জানা ছিলো না। যখন এমন ঘটনা ঘটার বিষয়ে জানজানি হলে তখন আমি জানতে পারলাম ওখানে কোচিং হচ্ছে। প্রতিষ্ঠান প্রধান একটা নীতিমালার আলোকে কোচিং করাতে পারে। তাতে কোনো সমস্যা নেই। এখন সে নীতিমালার আলোকে করলো, না নীতিমালার বাহিরে করলো সেটার বিষয়ে আমাদের নলেজ দিতে হয়। স্কুল সবেমাত্র বন্ধ হয়েছে তো, এখন বন্ধের পরপরই কোনো বন্ধ না দিয়ে উনি কন্টেনিউ করছে এই বিষয়টা আমার জানা নেই। এটার বিষয়ে টোটালী জেলা শিক্ষা অফিসার বরাবর জানানো হয়েছে।

থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সুমন ভক্ত জানান, ঘটনার বিষয়ে প্রথমে অপমৃত্যুর মামলা হয়। অপমৃত্যু মামলার বিষয়ের উপর তথ্য উদঘাটন করতে গিয়ে আমাদের সামনে আসল ঘটনা আসে। উক্ত ঘটনার বিষয়ে অনির মা কনিকা রায় বাদী হয়ে বুধবার একটি মামলা দায়ের করেন। আর সেই মামলার উপর ভিত্তি করে মামলার সাথে সংযুক্ত থাকা একজনকে আটক করা হয়েছে এবং অপর আসামীদেরকে আটকের চেষ্টা অব্যহত রয়েছে। আশা করছি আমরা অতিদ্রুত অন্যান্য আসামীদেরকে ধরতে সক্ষম হবো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *