মুহা: জিললুর রহমান,সাতক্ষীরা প্রতিনিধি”
ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ কক্সবাজার ও মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের ওপর দিয়ে আঘাত হানলেও এর প্রভাবে বাংলাদেশের সকল উপকূলীয় এলাকা জলোচ্ছ্বাসের সম্মুখীন হবে। ফলে ঝূঁকিপূর্ণ ও নিচু বেড়িবাঁধের কারণে উপকূলের বিস্তীর্ণ জনপদ প্লাবিত হয়ে অতীতের মতো ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। এই অবস্থায় জরুরি ভিত্তিতে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়েছে নাগরিক সংগঠন ‘সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা আন্দোলন’।
সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সংগঠক মনিরুজ্জামান মুকুল স্বাক্ষরিত ওই বিবৃতিতে বলা হয়, সুপার সাইক্লোন সিডর, আইলা, মহসিন, বুলবুল, আম্পান ও ইয়াসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিনিয়ত আঘাত হেনেছে উপকূলীয় এলাকায়। আগে ঝড়-বন্যা-জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হলেও এখন বর্যা মৌসুমে স্বাভাবিক জোয়ারের পানিতেই প্লবিত হয় উপকূলীয় এলাকা। দুর্বল বেড়িবাঁধ ভেঙে ও বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় উপকূলের জীবন ও জীবিকা। যে কারণে দীর্ঘদিন ধরে টেকসই বেড়িবাঁধের দাবি জানিয়ে আসছে উপকূলবাসী। কিন্তু দাবি বাস্তবায়ন না হওয়ায় ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ আসার খবরে পুরো উপকূলজুড়ে মানুষের মাঝে চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় এলেই বাঁধ ভাঙন আতংক দেখা দেয় শিশু, নারী, পুরুষ, বৃদ্ধসহ সমগ্র উপকূলবাসীর মধ্যে। কারণ সরকারের প্রতিশ্রুত সত্ত্বেও অধিকাংশ এলাকায় টেকসই বাঁধ নির্মিত হয়নি। ষাটের দশকে নির্মিত বাঁধগুলোর অনেক স্থানই মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে আছে। টেকসই বাঁধ নির্মাণে খুলনা, সাতক্ষীরাসহ উপকূলের কয়েকটি এলাকায় মেগা প্রকল্প নেওয়া হলেও তার বাস্তবায়ন শুরু হয়নি। ছোট ছোট প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। গত তিন বছরে অনেকটা দায়সারাভাবে বাঁধ মেরামত করা হয়েছে। বাঁধের পাশের মাটি তুলে বাঁধের উপর দেওয়া হয়েছে। এতে বাঁধের পাশের ভূমি দুর্বল হয়েছে। বাঁধ মেরামত করতে সেখানকার গাছ কেটে ফেলায় ঝুঁকি বেড়েছে।
এমতাবস্থায় আতংকিত না হয়ে ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য উপকূলীয় জনগণের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে বিবৃতিতে। একইসঙ্গে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে কোনো পয়েন্টে বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাৎক্ষণিক মেরামতের জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে অগ্রিম ব্যবস্থা রাখতে বলা হয়েছে। এছাড়া সাইক্লোন সেন্টারসহ আশ্রয় কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত ও পর্যাপ্ত শুকনো খাবার, পানিসহ অন্যান্য সামগ্রী মজুদ রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে প্রতিবছরই ছোট-বড় মিলিয়ে ৩/৪টি প্রাকৃতিক দূর্যোগ হানা দেয় উপকূলবর্তী এ জেলা সাতক্ষীরায়। এতে, জেলার উপকূলবর্তী তিন উপজেলা (শ্যামনগর-কালিগঞ্জ ও আশাশুনি) সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। বছরের বিভিন্ন সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সৃষ্ট নদী ভাঙনে গত কয়েক বছরে সহ¯্রাধিক ঘরবাড়ি, মসজিদ, হাফেজি মাদ্রাসাসহ বহু কৃষি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ফলে, ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসছে ওই সমস্ত উপজেলার উপকূলবর্তী অধিকাংশ গ্রাম। এতে, একদিকে যেমন নিঃস্ব হয়েছে উপকূলের বহু মানুষ। অপরদিকে সহায় সম্বল হারিয়ে বাসস্থান ছেড়েছেন অনেকে। গেল কয়েক বছরে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি পাওয়াতে দিশেহারা হয়ে পড়েছে উপকূলের মানুষ। প্রতিটা দুর্যোগের আঘাতের ক্ষত কাটিয়ে উঠতে না পারলেও এবার নতুন করে ঘূর্ণিঝড় মোখা ভাবাচ্ছে উপকূলবর্তী এ জেলার ২২লক্ষ মানুষকে।
শ্যামনগরের বাসিন্দা আল আমিন বলেন, দ্বীপ ইউনিয়ন হিসেবে পরিচিত আমাদের গাবুরা ইউনিয়নের চকবারা, লেবুবুনিয়া, হরিষখালীসহ কয়েকটি এলাকার বেড়ীবাঁধের ৮টি পয়েন্ট ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। ঝড়ের পূর্বে যদি ওই বাঁধ সংস্কার করা না হয় তাহলে ওই ইউনিয়নের একাধিক গ্রাম প্লাবিত হবে।
একই উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের সাহেব আলী নামে অপর এক ব্যক্তি বলেন, বর্তমানে বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের দুর্গাবাটির তিনটি পয়েন্ট ও দাতিনাখালীর একটি পয়েন্ট মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে এসব এলাকার বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হতে পারে। ইতিমধ্যে স্থানীয়দের মাঝে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের নুরুল ইসলাম বলেন, আমাদের ইউনিয়নের রুইয়ারবিল, কুড়িকাউনিয়া, সুভদ্রাকাটি, চাকলা, মাদারবাড়িয়া এলাকার বেশ কিছু পয়েন্ট অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। দ্রুতসময়ের ভিতরে যদি ওইসমস্ত এলাকার বাঁধ মেরামত করা না হয় তাহলে বড়ধরণের ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে।
এবিষয়ে সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভাগ-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ সালাউদ্দীন বলেন, আমাদের ডিভিশনের ৩৮০ কি.মি. বেড়িবাঁধের মধ্যে ৩কি.মি. অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে আমরা চিহ্নিত করেছি। ইতিমধ্যে ওই ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধের সংস্কার কাজ শুরু হয়েছে। আর, বড় কোন ধরণের দূর্যোগ না আসলে বাঁধ ভাঙার কোন আশঙ্কা নেই বলে জানান তিনি।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভাগ-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ শাহনেওয়াজ তালুকদার জানান, তার অধীনে প্রায় ৩২০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে অতিঝুকিপূর্ণ বাঁধ রয়েছে প্রায় ৩ কিলোমিটার। এছাড়া নিচু বেড়িবাঁধ রয়েছে ২০ কিলোমিটার। দুর্বল বেড়িবাঁধের উপর আমরা সার্বক্ষনিক নজরদারি করছি।
উল্লেখ্য, ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে দেশের উপকূলীয় এলাকায় ১০ থেকে ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। এরমধ্যে কক্সবাজার জেলার উপকূলীয় এলাকাগুলোতে ১৫ থেকে ২০ ফুট, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের উপকূলীয় এলাকাগুলোতে ১০ থেকে ১২ ফুট, বরিশাল বিভাগের জেলাগুলোতে ৮ থেকে ১২ ফুট ও খুলনা বিভাগের জেলাগুলোতে ৭ থেকে ১০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *