আন্তর্জাতিক ডেস্ক:তুরস্কে রবিবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান যখন ক্ষমতায় আসেন সে সময় তিনি নারীদের প্রচুর সমর্থন পেয়েছিলেন। এখন সেই সমর্থনে ভাটা পড়েছে মনে করছেন সে দেশের রাজনীতি বিশ্লেষকদের কেউ কেউ। দেশটির পত্রপত্রিকার খবর থেকে জানা গেছে, এবারের নির্বাচন হবে খুব প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক।

এই নির্বাচনে বিজয় অর্জন করা প্রেসিডেন্টে এরদোয়ানের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ হবে বলে জানা গেছে। তুরস্কে মোট ভোটারের ৫০ দশমিক ৬ শতাংশ নারী। একজন নারী অধিকার কর্মী বলেছেন নারীদের ভোট এবারের নির্বাচনে বড় ফ্যাক্টর।

ইস্তাম্বুলের শিক্ষার্থী ২৩ বছর বয়সী পেরিত। তিনি বলেন, ‘রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান যদি আবার জয়লাভ করেন, আমাদের সবার জীবন দুঃস্বপ্নের মতো হয়ে উঠবো।’ দেশের একটি স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বোয়াজিচি ইউনিভার্সিটিতে একজন সরকারপন্থি ডিন নিয়োগের প্রতিবাদে বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার কারণে তাকে প্রায় দু’মাস জেলে থাকতে হয়েছিল।

পেরিত এবং তার বন্ধু সুদ ও এমরু প্রথম ভোটার হয়েছে। এবার তার প্রথম ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। তুরস্কে এবার এরকম ভোটারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ। যারা রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানকে ছাড়া আর কোনো তুর্কি নেতৃত্বকে তাদের দেশ চালাতে দেখেননি।

এমরুর অভিযোগ লাগামহীন মূল্যস্ফীতির কারণে তুরস্কে তাদের মতো তরুণদের জীবন ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে। সরকারি হিসেবে বর্তমানে মূল্যস্ফীতির এই হার দাঁড়িয়েছে ৪৪ শতাংশ। দেশটির নাজুক এই অর্থনৈতিক পরিস্থিতির জন্য ব্যাপকভাবে দায়ী করা হয় প্রেসিডেন্টের এরদোয়ানের গৃহীত নীতিমালাকে। তিনি বলেন, ‘আপনার পক্ষে শুধু পড়ালেখা করে জীবন চালানো সম্ভব নয়, বেঁচে থাকতে হলে আপনাকে একটি পূর্ণকালীন চাকরিও জোগাড় করতে হবে।

সেই সুযোগ আমরা পাচ্ছি কই। তার বান্ধবী সুদও জানিয়েছেন যে রবিবারের পার্লামেন্ট ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি বিরোধী প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার পরিকল্পনা করছেন। আমি আমার আবেগ ও মতামত প্রকাশে নিরাপদ বোধ করছি না। কারণ যখনই এটা করি তখনই আমি আক্রমণের শিকার হই’, বলেন তিনি। বোয়াজিচি ইউনিভার্সিটিতে প্রতিবাদ বিক্ষোভে যোগ দেওয়ার জন্য এ বছরের শুরুর দিকে তাকেও ১২ মাসের স্থগিত কারাদণ্ড হয়।

পেরিত বিশ্বাস করেন প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ও তার দল একে পার্টির ২০ বছর ক্ষমতায় থাকার পর, এখন দেশটিতে পরিবর্তনের সময় এসেছে।

‘লোকজনের মনোভাব পরিবর্তনের জন্য কুড়ি বছর অনেক লম্বা সময়। এ সময় তারা গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সম্পর্কে একটা ধারণা অর্জন করেছে। এরদোয়ান যদি আবার জয়লাভ করেন তাহলে এটাই হয়তো আমাদের শেষ নির্বাচন হতে পারে,’ বলেন তিনি।

প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের দুই দশকের শাসনামলে তুরস্ক ক্রমেই একটি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সেই অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে সংসদীয় পদ্ধতিতে ফিরে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

ধারণা করা হচ্ছে, এবারের নির্বাচনে প্রধান দুই প্রার্থীর মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। বলা হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে এই প্রথম সবচেয়ে কঠিন এক নির্বাচনী পরীক্ষার মুখে পড়তে যাচ্ছেন।

তুর্কি প্রেসিডেন্টের সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন বিরোধী জোটের প্রার্থী কেমাল কুলুচদারুলু। ছয়টি বিরোধী দল নিয়ে গঠিত জোট ‘টেবিল এবং সিক্সের’ প্রতিনিধিত্ব করছেন তিনি।

তুরস্কের সরকারবিরোধী কয়েকটি প্রগতিশীল গ্রুপ এদোয়ানের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী কেমাল কুলুচদারুলু প্রতি সমর্থনের কথা ঘোষণা করেছে। এ কারণেই ৭৪ বছর বয়সী সাবেক এই সরকারি কর্মকর্তা বর্তমান প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের জন্য বড় ধরনের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছেন।

এবারের নির্বাচনে যারা ভোট দিচ্ছেন তাদের আট শতাংশ ‘ফার্স্ট-টাইম ভোটার’, মানে প্রথম প্রজন্মের ভোটোর। যারা প্রথমবারের মতো ভোট দিচ্ছেন। অনেকে মনে করেন তুরস্কে যেসব গ্রুপ এখনো মনস্থির করেননি যে তারা কাকে ভোট দেবেন, তাদের মধ্যে এই গ্রুপটি সবচেয়ে বড়।

তবে ২০ বছর বয়সী সালিহ কাকে ভোট দেবেন সেটা তার কাছে পরিষ্কার। বিবিসিকে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান একজন ক্যারিশম্যাটিক নেতা। তুরস্কের রাজনীতিতে এ ধরনের ক্যারিশমা থাকা গুরুত্বপূর্ণ।’

তিনি বিশ্বাস করেন এরদোয়ান তার শাসনামলের বিভিন্ন অর্জনের ওপর ভিত্তি করে তুরস্কের ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে পারবেন।

এর আগে তুরস্কে জ্বালানির বিষয়ে অনেক সমস্যা ছিল এবং সামরিক কারণে দেশটিকে অন্যান্য দেশের ওপর নির্ভর করতে হতো। কিন্তু এখন আমরা নিজেরাই নিজেদের গাড়ি উৎপাদন করছি, ড্রোন ও বিমান তৈরি করছি। এরদোয়ান আমাদের সব সমস্যা সমাধান করে দিয়েছেন, বলেন তিনি।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারে সব প্রার্থী এবার তরুণ ভোটারদের মন জয় করার চেষ্টা করেছেন। এরদোয়ান জোর দিয়েছেন প্রতিরক্ষা ও প্রযুক্তি খাতের অগ্রগতির ওপর, কিন্তু বিরোধী প্রার্থী কুলুচদারুলু আরো বেশি স্বাধীনতা ও উন্নত কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু ২০ বছর বয়সী গিজেম মনে করেন প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানই তুরস্কে সবার স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছেন। আজকের তুরস্কে যে যা করতে পছন্দ করে সেটাই সে করতে পারে। কয়েক দশক আগে তার বিরোধীরাই লোকজনের স্বাধীনতা খর্ব করেছে। আমার মতো যেসব নারী হিজাব পরতো তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ ছিল না, বলেন তিনি।

প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান তার শাসনামলে বড় ধরনের যেসব সংস্কার ঘটিয়েছেন তার একটি হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি চাকরিতে নারীর হিজাব পরার ওপর দীর্ঘদিনের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া।

আজকের দিনে এই দেশে যদি হিজাব পরিহিত কোনো ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা শিক্ষক থাকেন, তাহলে সেটা সম্ভব হয়েছে এরদোয়ানের জন্য। তিনিই এই স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছেন। তিনি যদি এটা না করতেন তাহলে আজকেও ধর্মনিরপেক্ষতার নামে আমাদের এই স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত থাকতে হতো, বলেন তিনি।

যেসব নারী সরকারি চাকরি করেন তাদের হিজাব পরার অধিকারের দাবিতে বিরোধী প্রার্থী কুলুচদারুলু গত বছর পার্লামেন্টে একটি বিল উত্থাপন করেছিলেন। তখন এরদোয়ান এই প্রস্তাবের ওপর গণভোট আয়োজনের প্রস্তাব দেন। এই বিষয়টির এখনো কোনো সমাধান হয়নি।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আরো দুজন প্রার্থী লড়ছেন: মধ্য-বামপন্থি ও জাতীয়তাবাদী মুহাররাম ইঞ্জে এবং ডানপন্থি জাতীয়তাবাদী সিনান ওয়ান।

সাম্প্রতিক জনমত জরিপে দেখা গেছে তরুণ ভোটারদের কাছে এই দুজন প্রার্থীর আবেদন রয়েছে। এবারের নির্বাচনে নারী ভোটাররা কাকে ভোট দেবেন সেটাও জয় পরাজয় নির্ধারণে বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

তুরস্কে মোট ভোটারের ৫০ দশমিক ৬ শতাংশ নারী। ধারণা করা হয় যে দেশটির রক্ষণশীল নারীরা দুই দশক আগে এরদোয়ানকে ভোট দিয়েছিলেন, যে কারণে তিনি ক্ষমতায় আসতে পেরেছিলেন। কিন্তু সেই সমর্থন এখন দুর্বল হয়ে পড়েছে। এখন তুরস্কের নতুন প্রজন্মের নারীরা অনেক অগ্রসর। এবং পুরনো সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কারমুক্ত।

পারিবারিক নির্যাতনের হাত থেকে নারীকে রক্ষা করার জন্যে যে আন্তর্জাতিক চুক্তি হয়েছিল সেই ইস্তাম্বুল সনদে তুরস্ক সই করেনি। একারণে তিনি বহু নারীর সমর্থন হারিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে নারীরা বিক্ষোভেও অংশ নিয়েছিল।

অতীতে এরদোয়ান যেসব নারী এখনও মা হননি তাদেরকে তিনি ‘অর্ধেক নারী’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। তিনি একজন নারীকে অন্তত তিনটি সন্তান নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান আরো বলেছিলেন নারী ও পুরুষকে সমান চোখে দেখা সম্ভব নয়। এরদোয়ান পিপলস অ্যালায়েন্স নামের যে জোট থেকে প্রার্থী হয়েছেন সেই জোটে রয়েছে চরম ইসলামপন্থি দল- হুদা পার। এ কারণে তার নিজের দল একে পার্টির অনেক নারী এমপির মধ্যেও উদ্বেগ রয়েছে।

নারীবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত গুলসুম কাভ বলছেন বর্তমান সরকার নারী-পুরুষের মধ্যে সাম্য প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাস করে না।

তিনি বলেন, এরদোয়ানের শাসনামলে নারী স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে। ‘শর্টস পরার কারণে নারীদের ওপর আক্রমণ করা হচ্ছে, নারী সংগীত শিল্পীরা যে ধরনের পোশাক পরেন তার জন্য তাদেরকে জেলে পাঠানোর হুমকি দেওয়া হচ্ছে এবং যৌন হয়রানির সমালোচনা করায় শিল্পীদের সাজা দেওয়া হচ্ছে।’

তারা চায় নারীরা ঘরে বসে থাকবে, কিছুই করবে না। কিন্তু নারীরা তো বদলে গেছে। তারা তুরস্ককেও বদলে দেবে, বলেন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *