ক্রমেই বিলীন হয়ে যাওয়া আবহমান গ্রামবাংলার ঐতিহ্যময় এই নির্দশনটি এক দশক আগেও রাতের আঁধারে রাস্তা পারাপার থেকে শুরু করে যাবতীয় কাজে অপরিহার্য্য ছিলো। তখন গ্রামে-গঞ্জে হারিকেন মেরামত করা মিস্ত্রীদের হাক শোনা যেতো। তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে হারিকেন মেরামত করতেন।
হারিকেন হচ্ছে জ্বালানি তেলের মাধ্যমে বদ্ধ কাচের পাত্রে আলো জ্বালাবার ব্যবস্থা। এর বাহিরের অংশে অর্ধবৃত্তাকার কাচের অংশ থাকে যাকে বাঙালিরা চিমনি বলে থাকে, এর ভিতরে থাকে তেল শুষে অগ্নি সংযোগের মাধ্যমে আলো জ্বালাবার জন্য সূতার পৈলতা। আর সম্পূর্ণ হারিকেন বহন করবার জন্য এর বহিরাংশে একটি লোহার ধরুনি থাকে, আলো কমানো বা বাড়ানোর জন্য নিম্ন বহিরাংশে থাকে একটি চাকতি যা কমালে বাড়ালে শলাকা ওঠা নামার সাথে আলোও কমে ও বাড়ে। গ্রামাঞ্চলে এর ব্যবহার ছিল সর্বাধিক। অনেক কাল আগে থেকে এর ব্যবহার শুরু হয়, সম্ভবত মোঘল আমলের আগে থেকে বাংলায় শুরু হয় হারিকেনের ব্যবহার।
বাংলায় সম্ভবত মোগল আমলের আগে থেকে হারিকেনের ব্যবহার শুরু হয়। বাঙালির জীবনে রাতের অন্ধকার দূর করতে একসময় গ্রামের মানুষের অন্যতম ভরসা ছিল হারিকেন। সেই সময় গ্রামীণ জীবনে অন্ধকার দূর করার একমাত্র অবলম্বন ছিল হারিকেন। এটি জ্বালিয়েই বাড়ির উঠানে কিংবা বারান্দায় পড়াশোনা করতো শিক্ষার্থীরা। সন্ধ্যাবেলা হারিকেনের কাচের চিমনি খুলে, ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে কেরোসিন তেল ঢেলে রেশার মধ্যে দিয়াশলাই দিয়ে আগুন জ্বালানো হতো। অনেক সময় আলো কমানোর জন্য যে চাকতি থাকত, সেটি বেশি ঘুরে গেলে পৈলতাটি তেলের ভেতর পড়ে যেত। হারিকেনের কেরোসিন তেল রাখার জন্য গ্রামের সব বাড়িতেই কাচের ও প্লাস্টিকের বোতলে গলায় রশি লাগিয়ে বাঁশের খুঁটিতে ঝুলিয়ে রাখা হতো।
সালে প্রথম আধুনিক কেরোসিন বাতিটি পোলিশ উদ্ভাবক ইগনাসি লাউকাসিউইচ (Ignacy Łukasiewicz) আবিষ্কার করেছিলেন। একই সময়ে, আমেরিকান ব্যবসায়ী রবার্ট ডায়েটজ (Robert Dietz) এবং তার ভাই প্রথম কার্যকরী ফ্ল্যাট উইক বার্নার পেটেন্ট করেছিলেন যা বিশেষভাবে কেরোসিনের জন্য ডিজাইন করা হয়েছিল। উভয় ধরনের কেরোসিন ল্যাম্পই সুবিধাজনকভাবে বহনযোগ্য ছিল, কেরোসিনের পাত্রে এবং আলোর উৎসের জন্য উইক বা ম্যান্টেল, কাচের গ্লোব বা টিউব দিয়ে সুরক্ষিত।
কথা হলো কেশবপুর উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ খালেক-এর ভাই আব্দুল মালেক মোড়লের(৬৫) সাথে। তিনি জানান, ছোটবেলায় আমরা হারিকেনের আলোতে লেখাপড়া করেছি। তখন ভাল হারিকেন ছিল বায়েজিদ ও তাজ। লেখাপড়া বেশি করতে পারিনি। আমি বহু বছর ধরে চাউলের ব্যবসা করে আসছি। সেই থেকে আজ পর্যন্ত হারিকেন ছাড়েনি। একসময় টোল দোকানে দোকানে কেরসিন দিয়ে যেত, আবার হাটের শেষে টাকা নিয়ে যেত।
কেশবপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধা সামছুর রহমান জানান, ঘরে ঘরে, রাস্তা-ঘাটে, হাট-বাজারে এখন বৈদ্যুতিক আলোর ঝলকানি। কিন্তু কালের বিবর্তনে প্রযুক্তির উৎকর্ষে হারিকেনের পরিবর্তে স্থান করে নিয়েছে পল্লীবিদ্যুৎ, সোলারপ্লান্ট এবং চার্জারলাইট। তাপ বিদ্যুৎ, জল বিদ্যুৎ, সৌর বিদ্যুতসহ দেশে আজ শতভাগ বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। জ্বালানিখাতে ব্যাপক উন্নয়নে হারিকেন বিলুপ্তির পথে। এখনো গ্রামের দু-একটি বাড়িতে হারিকেন পাওয়া যেতে পারে, সেগুলো হয়তো ময়লা ও মরিচা পড়ে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। নতুন প্রজন্ম হয়তো জানবেও না হারিকেন কী আর হারিকেন নিয়ে মানুষের স্মৃতিকাতরতার তাৎপর্য। তবে নতুন প্রজন্মের কাছে বাংলার এই ঐতিহ্যবাহী নিদর্শনটি টিকিয়ে রাখার দাবি জানাচ্ছেন অনেকে। নয়ত এক সময় চিরতরে বিলুপ্ত হবে এই সন্ধ্যা বাতি হারিকেন।
বিজ্ঞান প্রযুক্তি, আধুনিকতার ছোঁয়ায় গ্রাম অঞ্চলের সেই ঐতিহ্যবাহী হারিকেন এখন বিলুপ্তির পথে। চার্জার, বৈদ্যুতিক বাতি ও বিদ্যুতের নানা ব্যবহারের ফলে হারিকেনের ব্যবহার আজ আর দেখা যায় না। এখনো দু-এক বাড়িতে হারিকেন পাওয়া গেলেও ব্যবহার না করায় সেগুলোতে ময়লা ও মরিচা পড়ে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে।
বিদ্যানন্দকাটি গ্রামের সুধীর ঘোষ জানান, মঙ্গলকোট বাজারে আগে সন্ধ্যা নামলে জ্বালানি কেরোসিন তেল নেওয়ার জন্য মানুষের সিরিয়াল থাকতো।
মঙ্গলকোট বাজারে সবচেয়ে বড় দোকান ছিল প্রয়াত অজিত কুমার হালদারের। দোকানের একপাশে তার ভাই প্রয়াত সতীশ কুমার হালদার শুধু কেরোসিন ও ভোজ্য তেল বিক্রি করতেন। লাইন দিয়ে সাজানো থাকতো কেরোসিন তেলের বোতল। আর এখন তো পুরো বাজারে মুদির দোকানে কেরোসিন তেল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কেশবপুরে হারিকেন যা দুই-চারটি আছে তা এখন শুধুই স্মৃতি।