স্টাফ রিপোর্টার,চুয়াডাঙ্গা:
কম দামে উন্নতমানের বীজ কৃষকের হাতে তুলে দেওয়া বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) দায়িত্ব।
তবে বীজ বিতরণ নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। বীজ সংকট, ভেজাল, নিম্নমান, দামে নয়ছয়, বরা দ্দে ঘাপলাসহ নানা অনিয়ম ছাপিয়ে এবার বিপুল পরিমাণ বীজ অবিক্রীত থেকে যাওয়ার তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
অভিযোগ উঠেছে, বেসরকারি কোম্পানিকে বীজ বিক্রির সুযোগ করে দিতে গিয়ে বিএডিসি এ গ্যাঁড়াকলে নিজেরাই পড়েছে।
চলতি রবি মৌসুমে বিএডিসির ৩৭ হাজার টনের বেশি বীজ অবিক্রীত থাকায় সরকারের প্রায় ১ হাজার ৫০ কোটি টাকার লোকসান গোনার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে।
এসব বীজ এখন বিএডিসির জন্য ‘গলার ফাঁস’! বাধ্য হয়ে এই বীজধান এখন চাল বানিয়ে বেচা ছাড়া আর কোনো গতি নেই। এভাবে বেচলেও মোটা অঙ্কের টাকা গচ্চা যাবে সরকারের।
বীজ অবিক্রীত থাকায় বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদন কিছুটা কম হওয়ার শঙ্কা দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
উচ্চফলনশীল ধানের বীজ কাজে না লাগায় প্রায় ৪ দশমিক ২ লাখ টন খাদ্য উৎপাদন কম হতে পারে বলে ধারণা করছে ন তারা। এটি দেশের কৃষিতে বড় ধাক্কা বলেও মনে করেন কৃষি অর্থনীতিবিদরা।
অভিযোগ রয়েছে, বেসরকারি কোম্পানির বিক্রি বাড়াতে বিএডিসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার একটি চক্রের আঁতাতে কৃষকের কাছে সঠিক সময়ে বিএডিসির বীজ পৌঁছে না।
বেসরকারি সংস্থাগুলোর বীজ বিক্রি হয়ে যাওয়ার পর বিএডিসি বীজ বাজারে দেয়।
এতে প্রতিষ্ঠানটির বীজ অবিক্রীত থেকে যায়। এ ছাড়া দক্ষ জনবলের অভাব ও দায়িত্বে অবহেলার কারণেও কৃষক সর কারের কম দামের বীজ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএডিসির সাবেক এক মহাব্যব স্থাপক (বীজ) বলেন, বোরো মৌসুমের শুরুতে সঠিকভাবে তদারকি করা হলে এত বীজ অবিক্রীত থাকত না। মূলত অক্টোবর থেকে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যে বোরো বীজ রোপণ শুরু হয়।
এর পর আর বীজ রোপণের সময় থাকে না। ফলে এসব বীজ এই মৌসুমে কোনো কাজে আসে না।
তিনি বলেন, বেসরকারি কোম্পানির বীজ কখনও অবিক্রীত থাকে না। প্রতি বছর দেশে আমদানি করা উচ্চমূল্যের ১২ হাজার টন ভুট্টা বীজ বিক্রি হয়।
অথচ সরকার ভালো মানের ভুট্টা বীজ উচ্চ দরে সংগ্রহ করেও বিক্রি করতে পারে না।
জানা গেছে, বিএডিসির বীজ উৎপাদন করা হয় চুক্তিবদ্ধ চাষির মাধ্যমে। উৎপাদিত বীজ প্রক্রিয়াজাত ও সংরক্ষণ করে পরবর্তী মৌসুমে তা কৃষক পর্যায়ে সরবরাহ করা হয়।
বেসরকারি এবং বিভিন্ন সংস্থার উৎপাদিত বীজের চেয়ে বিএডিসির বীজে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি ফলন হয়ে থাকে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বিএডিসির ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মজুত বীজের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৭২ হাজার ৯৫০ টন।
আউশ, আমন, বোরো ধানের বীজ রয়েছে ৬৬ হাজার ২৪৭ টন। এর মধ্যে বোরো ধানের বীজ অবিক্রীত রয়েছে ২৮ হাজার ৫ টন।
এ ছাড়া উচ্চফলনশীল গম, ভুট্টা, ডাল বীজ, তৈল বীজ, সবজি বীজ, মসলা ও পাট বীজও অবিক্রীত রয়েছে ৫ হাজার ৬১৩ টন।
গম বীজ ৫ হাজার ১৯৩ টন, ভুট্টা বীজ ৩০ টন, ডাল ও তৈল বীজ  ৩৩০ টন, সবজি বীজ ১৩ টন, মসলা  ৪৪ টন।
উচ্চফলনশীল বোরো বীজ বিএডিসির সারাদেশের ২৭টি অঞ্চলে ৮ হাজার ৫৩৬ ডিলার এবং ১০০টি বীজ বিক্রয় কেন্দ্রের মাধ্যমে কৃষকদের মধ্যে বিক্রি করা হয়।
তবে এ বছর রবি মৌসুমে সব মিলিয়ে অবিক্রীত বীজ রয়ে ছে ৩৭ হাজার টন।
কৃষি অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এত বিপুল পরি মাণ বীজ অবিক্রীত থাকায় এ মৌসুমে ফসলের উৎপাদ ন কমে যাবে ৪ দশমিক ২ লাখ টনের বেশি।
আর এতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ১ হাজার ৫০ কোটি টাকারও বেশি।
গত ৩০ আগস্ট বিএডিসির মহাব্যস্থাপক (বীজ) স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে ২০২৩-২৪ বিতরণ বর্ষের জন্য বোরো ধানের বীজের দাম নির্ধারণ করা হয়।
১০ কেজি প্যাকেটে বিভিন্ন জাতের ভিত্তি বীজ ডিলার পর্যা য়ে প্রতি কেজি ৫৪ টাকা, কৃষক পর্যায়ে ৬২ টাকা। প্রত্যায়িত/মান ঘোষিত বীজ ডিলার পর্যায়ে প্রতি কেজি ৫০ টাকা, কৃষক পর্যায়ে ৫৭ টাকা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ডিলার বলেন, বিএডিসির বীজ ভালো। প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষকের কাছে এ বীজের জনপ্রি য়তা রয়েছে।
তবে কৃত্রিম সংকট তৈরির কারণে কৃষকরা এ বীজের নাগাল পাচ্ছেন না। ডিলারদের বীজ বরাদ্দ দেওয়া হয় দেরিতে।
ফলে একদিকে ভরা মৌসুমে সংকট তৈরি করা হয়, অন্যদি কে মৌসুম শেষে নানা অজুহাতে অবিক্রীত দেখানো হয়।
বাধ্য হয়ে অপেক্ষাকৃত বেশি দরে বেসরকারি আমদানি কার কদের কাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হচ্ছে।
বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানির বীজ বেশি বিক্রির সুযোগ তৈরি করে দিতে নানা কারসাজি চলে।
কখনও কৃত্রিম সংকট আবার কখন প্রণোদনার বীজে ভেজা লের কারণে সরকারি বীজের প্রতি কৃষকের আস্থাহী নতা তৈ রি করতে একটি চক্র কাজ করে।
এতে অসাধু বেসরকারি কোম্পানি নিম্নমানের বীজ বাজারে ছেড়ে দেয়, কৃষকরা হন প্রতারিত।
বীজ অবিক্রীত থাকার বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের বীজ অনু বিভাগের মহাপরিচালক (বীজ) মো. আবু জুবাইর হোসেন বাবলু বলেন, বিএডিসির বীজ অবিক্রীত থাকার বিষয় আমা র জানা নেই। কেন এত বীজ বিক্রি হয়নি, তার জবাব বিএডি সিই দিতে পারবে।
বিএডিসির সদস্য পরিচালক (বীজ ও উদ্যান) মো. মোস্তাফি জুর রহমান বলেন, কৃষকরা এখনও পুরোনো বীজ ব্রি আটা শ ও ঊনত্রিশের ওপর নির্ভরশীল।
কয়েক বছর ধরে ধানের এই দুটি জাতে রোগ ছড়িয়ে পড়ে ছে।
ফলে আমরা এবার উচ্চফলনশীল নতুন জাতের বীজ সংগ্রহ করেছি। কিন্তু কৃষকরা এখনও নতুন জাতের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেননি। ফলে বীজ অবিক্রীত থেকে গেছে।
বীজ নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে তিনি বলেন, কৃষকের কথা চিন্তা করেই বাজারে আমাদের বেশি বীজের সরবরাহ রাখতে হয়, যাতে বীজের কোনো সংকট না থাকে।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়েই বীজ মজুত করা হয়। এখনও মৌসুম শেষ হয়ে যায়নি।
আগামী মার্চ পর্যন্ত বোরো বীজতলা করা যাবে। এর মধ্যে মজুত থাকা বীজ বিক্রি হয়ে যাবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএডিসির এক কর্মকর্তা বলেন, চল তি বোরো মৌসুমের বীজতলা তৈরির কাজ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। ফলে অবিক্রীত থাকা বীজ দিয়ে আর চাষাবা দের সুযোগ নেই।
অবিক্রীত থাকা বীজ পরে কৃষককে ধান হিসেবে দিয়ে বিক্রি দেখানো হবে। কৃষক সেটি চাল বানিয়ে নিতে পারেন।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বীজ উৎপা দনে বিএডিসির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে ভুল থাকতে পারে।
আবার কৃত্রিম সংকট ও দাম বেশির কারণে হতে পারে তবে কৃষি মন্ত্রণালয়ের  উচিত তদন্ত করে দেখা।
One thought on “বে সরকারী কোম্পানি কে সুবিধা দিতে গিয়ে  বি এডিসি নিজেই গ্যাঁড়াকলে ”
  1. বে সরকারী কোম্পানি কে সুবিধা দিতে গিয়ে বি এডিসি নিজেই গ্যাঁড়াকলে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *