রহমত আরিফ ঠাকুরগাঁও সংবাদদাতাঃ ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে পরিবারকে না জানিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন ঠাকুরগাঁওয়ের বীর মুক্তি যোদ্ধা মাহবুবুর রহমান বাবলু। দেশ স্বাধীনের পর রাজনী তিও করেছেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে।

১৯৫৩ সালের ১৫ জুন ঠাকুরগাঁও শহরের আশ্রমপাড়া এলা কার বাসিন্দা প্রয়াত চিকিৎসক কুতুব উদ্দীন আহমেদ ও মহসেনা বেগম দম্পতির ঘরে জন্মগ্রহণ করেন মাহবুবুর রহমান বাবলু। পরিবারের ছয় ভাই ও তিন বোনের মধ্যে সবার বড় তিনি।

বর্তমানে তিনি ঠাকুরগাঁও জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বিডিনিউজ টোয়ে ন্টিফোর ডটকমকে একান্ত সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচা রণ করেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা।

ছাত্র রাজনীতি ভারত ভাগের পর ঠাকুরগাঁও সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রতি বছর ছাত্রলীগের নতুন কমিটি করা হত। ১৯৬৮ সালে অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় স্কুল শাখা ছাত্রলী গের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব নেন কিশোর মাহবুবুর রহমান বাবলু। পরে ১৯৬৯ সালে সাধারণ সম্পাদক ও ১৯৭০ সালে সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

১৯৭১ সালে ঠাকুরগাঁও জেলা ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক এবং দেশ স্বাধীনের পর ধাপে ধাপে সবশেষ ১৯৭৫ সালে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা র পক্ষে দুটি কারণ উল্লেখ করে মাহবুবুর রহমান বাবলু বলে ন, “একটি দেশ প্রেম এবং আরেকটি ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ।

“তবে যুদ্ধে অংশ নেওয়াতে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় পরিবার। স্বজ নরা কোনোভাবেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে দেবেন না। কিন্তু তাই বলে দেশকে পাকিস্তানিদের কাছে তুলে দিতে পারি না। তাই পরিবারকে না জানিয়ে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্র হণ করি।”

তিনি বলেন, “মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতি রোধ গড়ে তোলার জন্য সেই সময় দুটা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। এরমধ্যে একটি প্রশিক্ষণ নেওয়া হয়েছিল ভারতের শিলি গুড়িতে। সেই প্রশিক্ষণটি ছিল ২১ দিনের; যেখানে রাইফেল ও গ্রেনেড পরিচালনা শেখানো হয়।

“এরপর তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা সিরাজুল ভাইয়ের নির্দেশে দুই মাসের জন্য ভারতের বড় ক্যান্টনমেন্ট ও হাপ লাং হিল অর্থাৎ পাহাড়ের ওপর ‘মুজিব বাহিনী গেরিলা’ প্রশি ক্ষণ গ্রহণ করি।”

সেখানে নেতৃত্বে ছিলেন তোফায়েল আহমেদ, আবদুর রাজ্জা ক ও সিরাজুল ইসলামসহ আওয়ামী লীগের নেতারা; যেখা নে এন্টি পার্সোনাল মাইন, এন্টি ট্যাংক মাইন, গ্রেনেড থেকে শুরু করে এসএলআর, এলএলজি, রিকলগান চালানোর প্রশিক্ষণ নেওয়ার কথা জানান তিনি।

মাহবুবুর রহমান বলেন, “‘মুজিব বাহিনী গেরিলা’ প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য আমাকে ডেপুটি টিম লিডার হিসেবে লাল মনিরহাটের পাটগ্রাম, কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী ও ভুরুঙ্গামারী এলাকার দায়িত্ব দেওয়া হয়। নদী এলাকা হওয়ায় সেইসব অঞ্চলে বেশিরভাগ সময় নৌকায় করে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হত।

“অনেক ব্রিজ-কালভার্ট উড়িয়ে দিয়েছিলাম যাতে পাকিস্তানি সেনারা যাতায়াত করতে না পারে। পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে গুলির আঘাতে অনেক বন্ধুর শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল; চোখের সামনে অনেককে হারিয়েছি।”

সম্মুখ যুদ্ধের একটি ঘটনা তুলে ধরে মাহবুবুর রহমান বলেন, “পাটগ্রামে নদীর ওপারে একটি পাওয়ার হাউজ (বিদ্যুৎ কেন্দ্র) দখলে রেখেছিল পাকিস্তানি বাহিনী; সেটি দখলে নেওয়ার জন্য নদী পথে দুটি নৌকায় ভারী অস্ত্র নিয়ে ৫০ জন রওনা দেই। এ খবর রাজাকাররা পাকিস্তানি বাহিনীকে দিলে, তারা আমাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে শুরু করে।

সেই সময় আমরাও যুদ্ধের প্রস্তুতি নেই; কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত নৌকাটি উল্টে গেলে আমাদের অস্ত্র পানিতে তলিয়ে যায়।

“পরে সবাই নদী তীরে উঠতে পরলেও সাঁতার না জানায় আমি পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছিলাম।

আমাদের টিম লিডার এলাহী ভাই নদীর পাড়ে গিয়ে গরু-ছাগলের দড়ি সংগ্রহ করে আমার দিকে ছুড়ে মারে; সেটি ধরে তীরে উঠি এবং প্রাণে রক্ষা পাই।

ক্যাম্পে যাওয়ার পর ঘটনাটি শুনে আমাদেরকে শাস্তি দিয়ে ছিলেন ভারতীয় এক মেজর। শাস্তি মানতে গিয়ে আমাদের সবার হাতের কনুই ছিলে গিয়ে রক্তাক্ত হয়েছিল। সেই সময় ক্যাম্পের সেক্টর কমান্ডার এম কে বাশার এসে শাস্তি থেকে মুক্তি দেন।”

পরে তাকে টিম লিডার করে ঠাকুরগাঁও জেলার আটোয়ারী ক্যাম্পে স্থানান্তর করা হয় বলে জানান মাহবুবুর রহমান।

তিনি বলেন, “সেখানে যোগ দেওয়ার পর আউলিয়াপুর, চন্দনবাড়ি, বোদা, জগদল, ওমরখানা এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে আমাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়।

সেই সময় ৫০ জনের একটি দল পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে এলাহী ভাইকে হারিয়েছি।

পরে যুদ্ধ করতে করতে আমরা চারটি দলে ভাগ হয়ে ঠাকুর গাঁও শহরে প্রবেশ করি।

“যুদ্ধ করার সময় আমার এখনো একটা স্মৃতি মনে পড়ে; তা হলো- ঠাকুরগাঁও শহরের সেনুয়ায় পারিবারিক কবরস্থানে একটি কবরে সারারাত লাশের সঙ্গে বুকে অস্ত্র নিয়ে শুয়ে ছিলাম; সেদিন একটুও ভয় লাগেনি।”

মাহবুবুর রহমান বলেন, ঠাকুরগাঁও শহরে প্রবেশের সময় জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে বহু মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন।

তীব্র প্রতিরোধের কারণে পাকিস্তানি বাহিনী সেদিন পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল।

আর ৩ ডিসেম্বর ঠাকুরগাঁও জেলা হানাদারমুক্ত হয়। হাতে বিজয়ের পতাকা নিয়ে উল্লাস করতে থাকেন মুক্তিযোদ্ধারা।

দেশ স্বাধীনের অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে মাহবুবুর রহমান বলেন, “যেদিন খবর পেলাম পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে সেদিন মনে হয়েছিল, একজন অন্তঃসত্ত্বা বহু কষ্ট সহ্য করে যখন সন্তান জন্ম দেন, তখন ওই মায়ের চোখে-মুখে যেমন আনন্দের ছাপ ভেসে উঠে; ঠিক তেমনি বিজয়ের খবর পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠেছিলাম।”

মাহবুবুর রহমান বলেন, “কোনোদিন ভাবিনি মুক্তিযোদ্ধা হব। তবে মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার পেছনে আমার প্রেরণা জাতির জন ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর ডাকেই সেদিন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। যুদ্ধ শেষে ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর হাতে অস্ত্র জমা দিয়েছি।

“সেদিন বঙ্গবন্ধুর পা ছুঁয়ে সালাম করতে গেলে তিনি আমা কে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘তোদের স্থান আমার বুকে; তোরা দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান।’ বঙ্গবন্ধুর ওই স্মৃতি আজও মনে পড়ে।”

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মাহবুবুর রহমানের স্মৃতি-১৯৬৯ সালে ঠাকুর গাঁওয়ে ছাত্রলীগের কর্মীসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অংশগ্রহণ করেছিলেন। সেই সময় রিকশায় করে বঙ্গবন্ধু ঠাকুরগাঁও শহরে ঘুরেছিলেন এবং রাতে শহরের ডাকবাং লোতে রাত্রিযাপন করেছিলেন।

সেই রাতে ডাকবাংলোতে মাহবুবুর রহমান বাবলুসহ তৎ কালীন সাতজন ছাত্রলীগ নেতা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন। সেই দিন বঙ্গবন্ধু তাদের রাজনীতি নিয়ে নানা দিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন।

মাহবুবুর রহমান বলেন, “১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী হয়ে ঠাকুরগাঁও সফরে এসেছিলেন।

সেইদিন আমি ও ছাত্রলীগ নেতা রহিম মণ্ডল বঙ্গবন্ধুকে মালা পরিয়ে বরণ করে নিই।

এরপর অনুষ্ঠান শেষ করে বঙ্গবন্ধু তার গাড়িতে আমাকেসহ জেলার আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়ে পঞ্চগড়ের উদ্দেশে রওনা হন।”

এই বীর মুক্তিযোদ্ধা আক্ষেপ করে বলেন, স্বাধীনতার এত বছর পরও যখন বলতে হয়, এই দেশ রাজাকারমুক্ত হয়নি, তখন সত্যিই কষ্ট লাগে।

“তরুণ প্রজন্মের কাছে একটাই চাওয়া, আমরা যুদ্ধে করে একটি স্বাধীন দেশ তোমাদের দিয়েছি; এখন তোমাদের দায়ি ত্ব দেশকে রাজাকারমুক্ত করা।”

 

One thought on “কবরস্থানে সারারাত লাশের সঙ্গে অস্ত্র নিয়ে শুয়ে ছিলাম; ভয় লাগেনি’  ”
  1. কবরস্থানে সারারাত লাশের সঙ্গে অস্ত্র নিয়ে শুয়ে ছিলাম; ভয় লাগেনি’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *