মুহা: জিললুর রহমান, সাতক্ষীরা:
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বসবাস করছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলা সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকার মানুষ।

সেই সঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে তাদের জীবন ও জীবিকা। লবনাক্তার কারণে কৃষক তার জমিতে ফসল ফলাতে পার ছেন না, হালের পশু ও অন্যান্য গৃহপালিত পশুর খাদ্যের ব্যাপক সংকট দেখা দিয়েছে।

অতিরিক্ত লবণাক্ততার কারণে উপকূলের চাষযোগ্য জমি হারাচ্ছে ঊর্বরতা। এছাড়া প্রতিনিয়ত এই অঞ্চলের মানুষকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে স্বাস্থ্যজনিত বিভিন্ন সমস্যা ।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সাত ক্ষীরার ১ লাখ ৮৮ হাজার ৬২৬ হেক্টর আবাদি জমির মধ্যে ৮১ শতাংশেরও বেশি জমি অর্থাৎ ১লাখ ৫৩ হাজার ১১০ হেক্টর জমি লবণাক্ততায় রূপ নিয়েছে। আর পতিত জমি রয়েছে ৪০ হাজার ৯৮১ হেক্টর।

কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তন ঘটায় সাতক্ষীরায় বন্যা, খরা ও জলাবদ্ধতার পাশাপাশি মাটি ও পানির লবণাক্ততা বেড়ে গেছে।

এতে ক্রমেই আমন ধানের উৎপাদন কমে যাচ্ছে। গত চার বছরের ব্যবধানে আমন ধান উৎপাদন কমেছে ৩৩ হাজার টন।

সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ২০১৯-২০ মৌসুমে এ জেলায় রোপা আমন চাল উৎপাদন হয়েছিল ২ লাখ ৭৫ হাজার ৮৬ টন, ২০২০-২১ মৌসুমে উৎপাদন হয় ২লাখ ৫৮ হাজার ১০০ টন, ২০২১-২২ মৌসুমে উৎপাদন হয় ২লাখ ৪৬ হাজার ৭২৮ টন এবং
২০২২-২৩ মৌসুমে জেলায় আমন চাল উৎপাদন হয় ২ লাখ ৪১ হাজার ৮৫৮ টন। সেই হিসাবে ২০১৯-২০ মৌসুমের তুল নায় ২০২২-২৩ মৌসুমে ৩৩ হাজার ২৩৮ টন উৎপাদন কমে ছে।

কৃষির মতো সাতক্ষীরার সড়কগুলোতেও ফুটে উঠেছে জল বায়ু পরিবর্তনের ক্ষত। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উপ কূলীয় অঞ্চলে বৃষ্টি কমে গেছে। কয়েক বছরে মাটিতে বেড়ে ছে লবণাক্ততা। এ কারণে সাতক্ষীরার বিভিন্ন সড়ক-মহাসড় কে হাজার হাজার রেইনট্রি মারা গেছে বলে জানিয়েছেন পরিবেশবিদরা।

সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের প্রধান ড. নাসরিন আক্তার জানান, রেইনট্রি গাছ মরে যাওয়ার অনেক কারণের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মাটির লবণাক্ততা ও ক্ষার বেড়ে যাওয়া। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলেবৃষ্টিপাত কমে গেছে। সময়মত বৃষ্টি হচ্ছে না। মৌসুমি বৃষ্টি না হলে খাদ্যসং কটে পড়ে রেইনট্রি। তবে বিভিন্ন ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েও

গাছ মরে যেতে পারে বলে জানান তিনি।

এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রতিবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হানছে উপকূলে। এতে সহায়-সম্পদ হারা নোর পাশাপাশি সুপেয় পানির সংকট, চিকিৎসার অভাব, নারী-শিশুদের নিরাপত্তাহীনতা জীবনযাত্রা ও পরিবেশকে বিষিয়ে তুলেছে। উপকূলের এমন অবস্থার জন্য জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।
২০০৯ সালের আইলার পর থেকে গত ১৫ বছরে এক ডজনে র বেশিদুর্যোগের কবলে পড়েছে উপকূলের এ জেলা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য২ ০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’, ২০১৩ সালের ‘মহাসেন’, ২০১৫সালের ‘কোমেন’, ২০১৬ সালের ‘রোয়ানু’, ২০১৭ সালের ‘মোরা’,২০১৯ সালের ‘ফণী’, ২০১৯ সালের ‘বুলবুল’, ২০২০ সালেরআম্পান’, ২০২১ সালের ‘ইয়াস’, ২০২২ সালের ‘অশনি’ ওঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’।

প্রতিবছরই ছোট-বড় মিলিয়ে তিন-চারটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ
হানা দেয় সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকায়। এতে জেলার উপকূলবর্তী তিন উপজেলা শ্যামনগর, কালীগঞ্জ ও আশা শুনি সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। বছরের বিভিন্ন সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সৃষ্ট নদীভাঙনে গত কয়েক বছরে সহ¯্রাধিক ঘরবাড়ি, মসজিদ, মাদ্রাসাসহ বহু কৃষি জমি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। ফলে ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসছে ওই তিন উপজেলার অধিকাংশ গ্রাম।এতে সহায়-সম্বল হারিয়ে বাসস্থান ছেড়েছেন অনেক মানুষ।

উপকূলের বাসিন্দারা বলছেন, উপকূলের মানুষের জান মালের নিরাপত্তা ও জীবনযাত্রার উন্নয়নে এখনো পর্যন্ত কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এই অঞ্চলের শিশুরা শৈশবের ডানা মেলে অপুষ্টি আর অশিক্ষায়। জলবায়ু পরিবর্তন এ জেলার পুষ্টিহীনতার অন্য তমপ্রধান কারণ বলে জানা যায়।

গত ২০১৯ সালে জলবায়ু পরিবর্তন-সম্পর্কিত বিষয়ে সাতক্ষীরার দুটিউপকূলীয় উপজেলা নিয়ে জরিপ পরিচালনা করে স্থাানীয় উন্নয়ন সংস্থালিডার্স। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলার তিন লক্ষাধিক মানুষ বছরের প্রায় সাত মাস দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ইটভাটায়
অবস্থান করেন। আর এ সময় ওই সব পরিবারের শিশু সন্তানরা শিক্ষা থেকেপিছিয়ে যায়। জড়িয়ে পড়ে শিশুশ্রমে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবেক্রমবর্ধমান দারিদ্র্য ও পুষ্টির অভাব শিশুদের বিকাশে প্রতিবন্ধকতা তৈরিকরছে।

সাতক্ষীরা জেলা শিক্ষা অফিসের তথ্যমতে, ২০১৯ সালে এ জেলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ৩৩হাজার ৯৩৭ জন শিক্ষা র্থী অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যায়নরত ছিল। এই শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২০২২ সালের মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমানের পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল ২৬ হাজার ৪৮৭জন। অর্থাৎ ওই ব্যাচের কমপক্ষে ৭ হাজার ৪৫০জন শিক্ষার্থী
ঝরে পড়ে। আর এই শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার পেছনে জলবায়ু পরিবর্তন অন্যতম একটি কারণ বলে জানান সংশ্লিষ্ট শিক্ষা কর্মকর্তারা।

সুন্দরবন ঘেষা শ্যামনগরের দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরার বাসিন্দা হুদা মালী বলেন, খরা, ঝড়, বৃষ্টি ও নদীভাঙন আমাদের নিত্যসঙ্গী। আইলার পর থেকে গোটা এলাকা উদ্ভিদশূন্য। লবণাক্ততার কারণে সব গাছ মারা গেছে।

এলাকায় বসবাস করা খুবই কষ্টের। সব সময় সুপেয় পানির অভাবে থাকতে হয় বলে দাবি করেন তিনি।

তথ্যমতে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সাতক্ষীরার পাঁচ লাখের বেশি মানুষ সুপেয় পানির সংকটে। ঘূর্ণিঝড় আইলার তান্ডবের পর সাতক্ষীরার উপকূলীয় উপজেলাগুলোর বিভি ন্ন এলাকায় সুপেয় পানির সংকট তীব্র হয়। নষ্ট হয়ে যায় সুপেয় পানির উৎস। জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর বলছে, প্রতি লিটার পানিতে শূন্য থেকে ১হাজার মিলিগ্রাম লবণ থাকলে সে পানি পানযোগ্য। কিন্তু উপকূলে প্রতি লিটার পানিতে ১হাজার থেকে ১০ হাজার মিলিগ্রাম লবণ রয়েছে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, সাতক্ষীরার ১৩শতাংশ মানুষ খাওয়ার পানির সংকটে রয়েছেন বলে জানানো হলেও বাস্তবে এই চিত্র আরও ভয়াবহ। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা লির্ডাস, ব্র্রেড ফর দ্য ওয়ার্ল্ডসহ জলবায়ু অধিপরামর্শ ফো রামের তথ্যমতে, জেলার ২৩ লাখ ৪৬ হাজার ৬৮১জন মানু ষের মধ্যে পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ সুপেয় পানির সংকটে রয়ে ছেন।

জেলা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জুলফিকার আলী রিপন বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপক প্রভাব পড়ছে সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকায়। ঘনঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বর্তমানে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরা, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙন, জলাবদ্ধতা ও মাটির লবণাক্ততা উপকূলের প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

শীতের সময় অধি ক শীত, গ্রীষ্মে প্রচন্ড গরম এবং বর্ষায় অতিবৃষ্টির ফলেদূর্ভোগ বাড়ছে। এ ছাড়া জলোচ্ছ্বাসে নদীভাঙনে এসব এলাকার বহু মানুষ উদ্বাস্ত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সুনি র্দিষ্ট প্রভাবের কারণে সাতক্ষীরার মানুষ রেকড পরিমান তাপমাত্র অনুভব করছেবলে মন্তব্য করেন তিনি।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *