রহমত আরিফ ঠাকুরগাঁও সংবাদদাতাঃ জন্মের দুই বছর পর মারা যান বাবা বগা পাহান। দু’বছরের শিশুপুত্রকে নিয়ে চলে মা দুলালী পাহানের অভাবের সংসার।

অন্যের বাড়িতে কাজ করে ছেলের লেখাপড়া করান দুলালী পাহান। পঞ্চম শ্রেণিতে থাকা অবস্থায় তার মা অসুস্থ্য হয়ে পড়েন। এরপর মায়ের দেখাশোনা ওষুধসহ সংসারের যাব তীয় দায়-দায়িত্ব এসে পড়ে সুজন পাহানের কাঁধে।

নিজে কর্ম করে খাওয়ার মতো কিছুই রেখে যাননি তার বাবা। বসভিটা টুকুও অন্যের। কিন্তু মায়ের স্বপ্ন, অভাবের সঙ্গে লড়াই করে বড় হয়ে উঠা একমাত্র মেধাবী ছেলে একদিন অনেক বড় চাকরি করবে। সুজনের বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ের রুহিয়ার কশালগাঁও গ্রামে। আদিবাসী মুন্ডা সম্প্রদায়ের পরিবারে তার বেড়ে ওঠা।

মায়ের স্বপ্ন আঁকড়ে ধরে সুজন মাঠে কাজ করার পাশাপাশি নিজের পড়াশোনা অব্যাহত রেখেছেনl সুজনের সহপাঠীরা শিক্ষাজীবন থেকে অকালে ঝরে পড়লেও সুজন কষ্ট করে নিজের শিক্ষা-জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সুজন বর্তমানে রুহিয়া ডিগ্রি কলেজে ডিগ্রি ২য় বর্ষের পরিক্ষা দিয়ে ৩য় বর্ষে ভর্তির অপেক্ষায় আছেন।

দেখা যায়, হাতে কাস্তি নিয়ে ফসলের মাঠে ধান কাটতে কাটতে, কখনও আবার গৃহস্থালির কাজ করতে করতে, চলতে ফিরতে শিশুদের নিয়ে সব সময় ইংরেজিতে কথা বলার চর্চা জারি রেখেছেন অদম্য সুজন। প্রতিবেশীরা ভিনদেশি ভাষা বুঝতে না পারায় অনেক সময় হাসি-ঠাট্টা করে তাকে পাগলও বলে। তবুও ইংরেজিতে কথা বলার চর্চা থামাননি এই যুবক। ছোট্ট একটি কুঁড়ে ঘর থেকে তিনি স্বপ্ন দেখেছে নিজের জীবনমান উন্নয়ন করে কীভাবে সমাজের পিছিয়ে পড়া শিশুদের সামনে এগিয়ে নেয়া যায়। তাদের কাছে নিজেকে অনুপ্রেরণা হিসেবে গড়ে তোলার।

সুজন পাহান বলেন, স্মার্ট ও টেকনোলজির যুগে ভালো কিছু করতে গেলে বাংলা ভাষার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজি শেখাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অভাব অনটনের সংসারে যেখানে পাঠ্যবই পড়ার সময় নেই। সেখানে ভালো ইংরেজি শিখতে চাওয়াটা নিজের কাছেও কখনো কখনো অপ্রাসঙ্গিক লেগেছে, তবে প্রবল আগ্রহ ও ইচ্ছাশক্তির কাছে অসম্ভব বলে কিছু নেই। আমি ফেসবুকে ইংরেজিতে কথা বলার ভিডিও দেখেই ইংরেজি রপ্ত করার চেষ্টা করেছি এবং নিজের ইংরেজি চর্চার ভিডিও ফেসবুকে আপলোড করছি। কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে ইংরেজি কোর্স করার সুযোগ সৃষ্টি হয়নি জীবনে।

সুজন বলেন, সারা দিন ইংরেজিতে কথা বলার চেষ্টা করি। মানুষ হাসি-ঠাট্টা করে। অনেকেই ভাবে আমার বুঝি মাথার সমস্যা দেখা দিয়েছে, কিন্তু আমি এসবের তোয়াক্কা করি না। মাঠের ফসলের সঙ্গে কাজের সময়, গৃহস্থালির কাজে ও গবাদি পালনের সময় সবখানে ইংরেজিতে কথা বলার চেষ্টা করি। মাঠে কাজ করে যা আয় হয় তা দিয়ে নিত্যদিনের খরচ আর জীবনযাপনে চলে যায়। একটি ছোট চাকরি হলেও স্বপ্ন পূরণে একধাপ এগোতে পারবো।

সুজনের সঙ্গে মাঠে কাজ করছিলেন কৃষক বিনয় পাহান। তিনি বলেন, আমি সুজনের সঙ্গে একই স্কুলে পড়তাম, অভাবের কারণে পড়াশোনা ছেড়েছি। কিন্তু সুজন অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করেও পড়াশোনা করছে। ও অনেক মেধাবী।

সুজন সমাজে পিছিয়ে পড়া শিশুদের মাঝে বিলাতে চান নিজের ভেতরে থাকা শিক্ষার আলো। তার আগে নিজেকে ভেঙে গড়ার সুযোগ দরকার সবার আগে।

সুজনের মা দুলালি পাহান বলেন, আমার ছেলের ইচ্ছাশক্তি অনেক। অনেক কষ্টে তাকে বড় করেছি। যদি নিজে কাজ করতে পারতাম তাহলে তাকে কখনও সংসার সামলাতে এত চাপ নিতে হতো না। ছেলেটার একটি চাকরি হলে খুব ভালো হতো। নিজেকে মেলে ধরে দেশের কল্যাণে কাজ করতে পারতো।

এ বিষয়ে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা (ইউএনও) বেলায়েত হোসেন বলেন, মেধাবী ও প্রতিভাবান যারা আছে তাদের জন্য সরকার সব সময় কাজ করছে। আমরা যারা সরকারের প্রতিনিধি আছি আমাদের কাজ সরকার বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পৌঁছে দেওয়া। তাই সুজন পাহানকে ডেকে তার কাছে জানা হবে। তার কি কি বিষয় সহযোগিতা প্রয়োজন। সে অনুযায়ী তাকে সহযোগিতা করা হবে।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *