মেহেদী হাসান,স্টাফ রির্পোটার,যশোর:
যশোরের যশ খেজুরের রস।’এটি ছিল এ জেলার অন্যতম ঐতিহ্য। তাই এই ঐতিহ্য ধরে ধাখতে চৌগাছা উপজেলা প্রশাসন ভিন্ন ধর্মী উদ্যোগও গ্রহন করেছে।

গত বছর (২০২৩)  সালে সাবেক চৌগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইরুফা সুলতানা ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ ড.মোঃ মোস্তানিছুর রহমান যশোরের খেজুরের গুড়ে র ঐতিহ্য ধরে রাখতে নানা মুখী উদ্যোগ নিলে,স্থানীয় জন প্রতিনিধি, গাছিসহ বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষ তাদেরকে স্বাগত জানায়।

এ সময় থেকে উপজেলা প্রশাসন পতিত জমিতে খেজুর গাছ ও বীজ রোপন ,গুড়ের মেলা,গাছিদের প্রশিক্ষন,গাছি সমিতি গঠনসহ নানামূখী কার্যক্রম শুরু করে।

এরই ধারাবাহিকতায় এবছরও আগামী ২৯,৩০ ও ৩১ জানু য়ারী উপজেলা পরিষদ চত্তরে গুড়ের মেলার আয়োজন করা হয়েছে।

এ তথ্য আজ (২৭ জানুয়ারী) শনিবার উপজেলা নির্বাহী কর্মকরতা সুস্মিতা সাহা স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছে আনু ষ্ঠানিকভাবে ঘোষনা করেছেন।

যশোর জেলায় খেজুর গাছেট তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে,
গত পাঁচ বছরে খেজুর গাছ কমেছে ৫০ হাজার,গাছি কমে ছে দেড় হাজার।

গাছ এবং গাছি কমে যাওয়ায় ৫৫ লাখ লিটার খেজুর রস আহরণ কমে গেছে।

ফলে ১ লাখ ৫০ হাজার কেজি গুড়ের উৎপাদনও কমে গেছে। এভাবে ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাচ্ছে ‘যশোরের যশ, খেজুরের রস।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী,যশোরে ১৬ লাখ ২৫ হাজার ৩৫০টি খেজুর গাছ থাকলেও রস সংগ্রহ হয় ৩ লাখ ২১ হাজার ৮২৩টি গাছ থেকে।

বাকি ১৩ লাখ গাছই রস সংগ্রহের বাইরে আছে। গাছ ছোট হওয়া ও গাছির সংখ্যা কমে যাওয়া এর প্রধান কার ণ।

এর বাইরে সবচেয়ে আশঙ্কাজনক তথ্য হচ্ছে বিগত পাঁচ বছরে খেজুর গাছ কমেছে ৫০ হাজার, আর গাছি কমেছে দেড় হাজার।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য মতে, ২০১৯ সালে যশোর জেলায় মোট খেজুর গাছ ছিল ১৬ লাখ ৬২ হাজার ৪৭৫টি। এর মধ্যে ৩ লাখ ৭১ হাজার ৪৬৫টি গাছ থেকে রস সংগ্রহ করা হতো।

গাছি ছিল ৬ হাজার ৮৫০ জন। প্রতিটা গাছ থেকে রস উৎপাদন হয়েছে গড়ে ১২৫ কেজি এবং গাছ প্রতি গুড় উৎপাদন হয় ১৩ কেজি।

২০২০ সালে মোট খেজুর গাছ ছিল ১৬ লাখ ৫৯ হাজার ৭৫০টি। রস সংগ্রহ হয়েছিল ৩ লাখ ৬৭ হাজার ৫৬০টি থেকে। গাছির সংখ্যা ছিল ৬ হাজার ৭২০ জন। প্রতিটা গাছ থেকে রস উৎপাদন ১২৫ লিটার এবং গাছ প্রতি গুড় উৎপাদন হয় ১২ কেজি।

২০২১ সালে খেজুর গাছ কমে দাঁড়ায় ১৬ লাখ ৫৩ হাজার ২৭৫টি। রস সংগ্রহের গাছের সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ৫২ হাজার ৪৩৫টি।

গাছির সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৫ হাজার ৫৩০ জন। প্রতিটা গাছ থেকে রস উৎপাদন হয় গড়ে ১২০ লিটার এবং গুড় উৎপাদন হয় ১৩ কেজি।

২০২২ সালে মোট খেজুর গাছ আরও কমে হয় ১৬ লাখ ৪১ হাজার ১৫৫টি। আর রস সংগ্রহের গাছের সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ৪৯ হাজার ৯৫৫টি।

গাছির সংখ্যা হয় ৫ হাজার ১৫০ জন। প্রতিটা গাছ থেকে রস উৎপাদন হয় ১২০ লিটার এবং গুড় উৎপাদন হয় ১২ কেজি।

২০১৯ থেকে ২০২৩ এ ৫ বছরে গাছের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ২৫ হাজার ৩৫০টি।

এর মধ্যে রস সংগ্রহ হচ্ছে ৩ লাখ ২১ হাজার ৮২৩ টি গাছ থেকে। গাছির সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৫০ জনে।

প্রতিটা গাছ থেকে রস উৎপাদন হয় গড়ে ১১৪ লিটার, প্রতিটি গাছ থেকে গুড় উৎপাদন হয় গড়ে ১০ কেজি। ৫ বছরে রসের উৎপাদন কমেছে ৫৫ লাখ লিটার।

এসময়ে গুড়ের উৎপাদন কমেছে ১ লাখ ৫০ হাজার কেজি।

জেলায় সবচেয়ে বেশি রস গুড় উৎপাদন হয় চৌগাছা ও বাঘারপাড়া উপজেলায়। সেখানকার চিত্রও আশঙ্কাজনক।

বাঘারপাড়া উপজেলায় পূর্ণ বয়স্ক খেজুর গাছ রয়েছে ৫ লাখ ৫৪ হাজার। রস দেওয়া গাছের সংখ্যা মাত্র ৪৫ হাজার।

আর গাছির সংখ্যা ১ হাজার ৪৫ জন। রস উৎপাদন হয় ৫০ হাজার লিটার।

চৌগাছার পেটভরা গ্রামের আব্দুল মাজিূ বলেন, যত সম স্যা খেজুর গাছে। দু’বছর আগেও রাস্তা করার সময়ও অনেক খেজুর গাছ মারা পড়ে।

মোট মাঠ কুড়িয়ে ২০/২৫টি গাছে রস হয়। আগের সেই বড় আর গাছ নেই। বড় গাছে রস বেশি হয়, মিষ্টিও হয়। বড় গাছ না থাকায় রসের পরিমাণ কম হচ্ছে।

চৌগাছার স্বরুপপুর চাকলা গ্রামের হযরত আলী বলেন, গাছ কাটার মানুষ নেই। এখন সবাই গাছে উঠতে ভয় পায়। ২-৩ বছর আগে গাছ কাটার অভাবে মাঠে অনেক খেজুর গাছ পড়ে থাকতো। তবে বর্তমানে মাঠে খেজুর গাছ নেই বললেই হয়।

চৌগাছার যাত্রাপুর গ্রামের কৃষক গোলাম হোসেন বলেন, খেজুর গাছের বাগান নষ্ট হয়েছে ইট ভাটার কারণে। ৮-১০ বছর আগে মাঠের প্রতিটা আইলে এবং জমির মাঝেও খেজুর গাছ ছিল। এখন আমাদের মাঠে ১০০ গাছও নেই।

চৌগাছা উপজেলার যাত্রাপুট গ্রামের তোরাব আলী বলেন, এক যুগের বেশি সময় ধরে খেজুর গাছ কাটছি।

আগে এক সময় ১০০ থেকে ১৫০টি গাছ কাটতাম। কিন্তু এখন গাছের সংখ্যা কমে যাওয়ায় প্রতি মৌসুমে ৩০ থে কে ৩৫টি গাছ কাটছি।

তিনি আরও বলেন, এক ভাড় রস ৩০০ টাকা, এক কেজি পাটালি গুড় ৪০০ টাকা।

তারপরও লোকজনের চাহিদা অনুসারে ঠিকমতো দিতে পারি না। গাছ বেশি হলে প্রতি মৌসুমে লাখ টাকা আয় করা সম্ভব।

চৌগাছা উপজেলার মির্জাপুর গ্রামের জিন্নাত আলী বলেন, এক সময় অনেকগুলো গাছ কাটতাম।

এখন ৩০ টার মতো গাছ কাটি। তা থেকে যে রস হয় তা এলাকায় লোকজনের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না।

তবে চৌগাছা উপজেলা প্রশাসনের নানামুখী উদ্যেগ গ্রহন করার কারনে গাছিদের মধ্যে বিগত দিনের থেকে আগ্রহ ও উৎসাহ বেড়েছে বলে মনে করি।

যশোর জেলা কৃষি অধিদফতরের উপ-পরিচালক ড. সুশান্ত কুমার তরফদার বলেন, সাধারণত কৃষক খেজুর গাছের বাগান করতে চাই না। কারণ গাছ থেকে রস সংগ্রহ করার মধ্যে অনেক জটিলতা রয়েছে। আমরা এ জটিলতাকে আধুনিকায়ণ করতে প্রচেষ্টায় আছি।

আমাদের কৃষি বিভাগ থেকে পতিত জমিতে খেজুর গাছ লাগানোর জন্য কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হয়।

আবার সরকারিভাবেও গাছিদের প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। এ প্রণোদনা চালু থাকলে কৃষকও উদ্বুদ্ধ হবে।

তবে বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় রাস্তার দু’পাশ দিয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগ এবং বন বিভাগ খেজুরের চারা রোপণ করে। এ চারা দেখা বা পরিচর্যার দায়িত্বও তাদের।

গুড় উৎপাদন করে কৃষক যেহেতু কিছুটা লাভবান হচ্ছে। আশা করি গাছের পরিমাণও আর তেমন কমবে না।

উল্লেখ্য,যে,সেভ দ্য ট্র্যাডিশন অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিলয়ের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ আবু বকর ২০২২ ও ২০২৩ সালে যশোর অঞ্চলের খেজুর গাছ ও সংশ্লিষ্ট গাছিদের নিয়ে প্রথম গবেষণার কার্যক্রম শুরু করে ন।

প্রতিটি গ্রামে গিয়ে তিনি গাছিদের নিয়ে শুরু করেন উঠান বৈঠক। এছাড়া খেজুর গাছ রক্ষা ও গাছিদের নিয়ে তিনি আন্দোল নও শুরু করেন।

ওই সময় তিনি তথ্য প্রকাশ করেন অত্র অঞ্চলে একদশক আগেও খেজুর গাছের সংখ্যা ছিল প্রায় দেড় লাখের বেশী। বর্তমানে প্রায় ৫৫ হাজার খেজুর গাছ রয়েছে।

এছাড়া এক দশক আগেও ৪ থেকে ৫ হাজার গাছি থাকলেও নানা কারনে সেই সংখ্যা মাত্র ৮’শ ৫০ এ দাঁড়িয়েছে।

তিনি বলেন খেজুর গাছ রক্ষা, গাছিদের উন্নয়ন ও গুড় বাজা রযাতের নিশ্চয়তা প্রদান করা হলে খেজুর গাছের প্রতি আ গ্রহ তৈরি হবে।

একই সাথে গুড়ের উৎপাদনও বৃদ্ধি পাবে। খেজুর গাছ নিয়ে তাঁর এই আন্দোলন ও গবেষণার বিষয়টি তিনি সাবেক নির্বা হী কর্মকর্তা ইরুফা সুলতানার কাছে অবহিত করেন।

তিনি খেজুর গাছ রক্ষা ও গাছিদের উন্নয়নের সহযো গিতা কামনা করেন।

সে সময়কার চৌগাছা নির্বাহী কর্মকর্তা ইরুফা সুলতানা ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ড.এম মেস্তানিছুর রহমান তাঁর এই বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন কার্যক্রম শুরু করেন।

সেই কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায় গত বছরের ১৬ ও ১৭ জানুয়ারি খেজুর গুড়ের মেলার আয়োজন করা হয়।

সেই সাথে খেজুর গাছ রোপন ও গাছিদের নিয়ে সমাবেশ সমিতি গঠন সহ নানা কার্যক্রম শুরু করা হয়।

One thought on “যশোরের খেজুরের রস ও গুড়ের ঐতিহ্য ধরে রাখতে নানা মুখী উদ্যোগ”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *