মুহা: জিললুর রহমান,সাতক্ষীরা:
সাতক্ষীরা শহরের অদূরে বিনেরপোতা এলাকায় গড়ে উঠা শুটকি রাখানায় প্রস্তুতকৃত মিঠা পানির শুঁটকির চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।

এখানে প্রস্তুতকৃত শুঁটকি যাচ্ছে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম ও উত্তরবঙ্গসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।

এসব জেলায় ইতিমধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে সাতক্ষীরার মিঠা পানির শুঁটকি। পাশাপাশি সাতক্ষীরার স্থানীয় মৎস্য
খামারিদের আংশিক চাহিদা মেটাতেও সক্ষম হয়েছে এই কারখানাটি।

খোঁজ নিয়ে যানা যায়, সম্পূর্ন ব্যক্তি উদ্যোগে ২০১৭ সালে
সাতক্ষীরা শহরের অদূরে বিনেরপোতা এরাকায় বেতনা নদী র ধার ঘেষে একটি শুঁটকি কারখানা গড়ে তোলেন মৎস্য ব্যবসায়ি প্রশান্ত বিশ্বাস।

এই কারখানায় শুঁটকি প্রস্তুতের কাজে নিয়োজিত রয়েছেন ২৫ জন কর্মচারী।

স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত সিলভার কাপ, রুই, মৃগেল,কাতলা, পুঁটিসহ অন্যান্য মিঠা পানির মাছ প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে শুঁটকিতে রূপান্তর করা হয় এখানে।

ইতিমধ্যে মৌসুম শুরু হওয়ায় শুঁটকি শুকা তে ব্যস্ত সময় পার করছেন এখানকার কর্মচারীরা। শুঁটকির গুণগত মান ধরে রাখতে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রেখে মানসম্মত
শুঁটকি বাজারজাত করছেন ব্যবসায়ীরা।

শুঁটকি কারখানার সাথে সংশ্লিষ্টদের মতে, সাতক্ষীরায় উৎপা দিত বিভিন্ন ধরনের সাদ মাছ বানিজ্যিক ভিত্তিতে ঢাকা ও চট্রগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন আড়তে চলে যায়।

প্রতিদিন অর্ধশতাধিক ট্রাকে এখানকার সাদা মাছ চলে যায় জেলার বাইরে। ফলে বাইরের ক্রেতাদের কারণে তুলনামূলক চড়া দামে এখানকার মাছ কিনতে হয়।

তবে সে তুলনায় বিক্রি দাম একটু কম। কারণ সামুদ্রিক মাছ মিঠা পানির মাছের তুলনায় অল্প দামে ক্রয় করা হয় এবং লবণাক্ত পানির শুঁটকি মাছ মিঠা পানির মাছের তুলনায় কম দামে পাওয়া যায়।

সেই দিক দিয়ে বিবেচনা করলে মিঠা পানির শুকটিতে প্রতি বছরই কম বেশি লোকসানের সম্মুখীন হতে হয় তার। আবার কোনো মৌসুমে পড়তা করে সুবিধামত মাছ কিনতে পারলে খরচ বাদ দিয়ে ৪-৫ লাখ টাকা লাভ পাওয়া যায়।

তবে গত মৌসুমে আড়াই লাখ টাকা লোকশানে হওয়ায় চলতি মৌসুমে কাজের ক্ষেত্রে বেশ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে কারখানাটির।

এদিকে আর্থিক সংকটের কারণে চাহিদার তুলনায় শুঁটকি সরবরাহ হচ্ছে না। এখানে মাসে সর্বনিম্ন ৮ টন মাছ শুঁটকিতে রূপান্তর করা হয়।

এভাবে ধারাবাহিকভাবে বছরে ৬ মাস শুঁটকি কার্যক্রম প্রক্রি য়াধীন থাকে। প্রতি মৌসুমে প্রায় ৫০-৫৫ টন শুঁটকি দেশের
বিভিন্ন জেলাতে সরবরাহ করা হয় এ কারখানা থেকে।

এখানকার শুঁটকি মাছ রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, সৈয়দপুর, পঞ্চগড়, রাজশাহীসহ উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে চাহিদা অনুযায়ী নিয়মিত সরবরাহ করা হয়ে থাকে।

প্রথমে এসব জেলার পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে শুঁটকি পৌঁছায়, সেখান থেকে খুচরা বিক্রেতারা জেলার সর্বত্র বিক্রি করে থাকেন। প্রতি কেজি শুঁটকি ২৫০-৩০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়ে থাকে। মাছের ভিন্নতার কারণে দামের পরিবর্তন হয়।

এ শুঁটকির জনপ্রিয়তার কারণ হলো উত্তরাঞ্চলে মিঠা পানির শুঁটকি সহজলভ্য না।

সেক্ষেত্রে সাতক্ষীরায় প্রস্তুত করা মিঠা পানির শুঁটকি ধীরে ধীরে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলার মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।

জনপ্রিয়তা ও চাহিদার উপর ভিত্তি করে উত্তরাঞ্চলের জেলা গুলোতে নিয়মিত শুঁটকির সরবরাহ করা হয়ে থাকে।

জেলার শুঁটকি পল্লীর মালিকের দাবি, সাতক্ষীরার তৈরি মিঠা পানির শুঁটকি ইতিমধ্যে সারাদেশে বেশ সুনাম অর্জন করেছে।

তবে তুলনামূলক লভ্যাংশ না পাওয়ায় এই ব্যবসার প্রতি একরকম অনাস্থা চলে এসেছে ব্যবসায়ীদের। সেক্ষেত্রে সরকারি সহায়তা পেলে সাতক্ষীরার একমাত্র মিঠা পানির শুঁটকির এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব।

এই শুঁটকি শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে পারলে পরিবর্তন আসবে সাতক্ষীরার অর্থনীতিতে।

অপরদিকে মৎস্য অধিদপ্তর বলছে, শুঁটকির গুণগত মান ঠিক রাখতে ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট কাজের সঙ্গে জড়িত সকলকে প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে। তাছাড়া তাদের সার্বিক সহযোগিতার বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপ ক্ষকে জানানো হয়েছে।

শুঁটকি পল্লীর কর্মচারী তপন চন্দ্র মন্ডল বলেন, এই এলাকায় শুঁটকির কারখানা হওয়ায় এখানে অনেকের কর্মসংস্থান হয়েছে।

জানা মতে, জেলায় আর কোথাও মিঠা পানির শুঁটকি প্রক্রিয়াকরণের কারখানা নেই।

তাই নিজেদের সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে শুঁটকির সুনাম ধরে রাখার চেষ্টা করা হয় এখানে। এ কাজ করে বাড়তি আয় হচ্ছে এ অঞ্চলের মানুষদের।

বিনেরপোতা মাছের আড়তের ব্যবসয়ী সঞ্জয় কুমার বলেন, এই এলাকায় শুঁটকির একটি কারখানা গড়ে উঠায় সাদা মাছ থেকে শুঁটকিতে রূপান্তর করা পেশার সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে অনেকেই জড়িত রয়েছে।

অনেকের কর্মসংস্থান হয়েছে ওই করাখানায়। তবে যতদূও শুনেছি গত বছরের তুলনায় চলতি মৌসুমে অর্থনৈতিক সং কট থাকায় শুঁটকিশিল্পকে বিস্তৃৃতি ঘটাতে কষ্টকর হয়ে দাঁড়ি য়েছে মালিকের পক্ষে।

শুঁটকি পল্লীর মালিক বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণের আবেদন করলেও সেখান থেকে সন্তোষজনক কোনো সাড়া পায়নি এখনো।

এজন্য ব্যবসার পরিসর ঘটাতে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে। তবে পরিকল্পিতভাবে এই শিল্পকে যদি ধরে রাখা যায় সেক্ষেত্রে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরার অনেক মানুষ এই পেশার সঙ্গে থেকে সুন্দরভাবে জীবনযাপন করতে পারবে।

শুঁটকি পল্লীর মালিক প্রশান্ত বিশ্বাস বলেন, আমার এই শুঁট কি পল্লীতে রুই, পুঁটি, মৃগেল, সিলভার কাপসহ অন্যান্য মিঠা পানির মাছের শুঁটকি তৈরি করা হয়। ইতিমধ্যে দেশের গন্ডি পেরিয়ে পার্শ্ববর্তী ভারতেও রপ্তানি করছে দেশের পাইকারি ব্যবসায়ীরা। এই শুঁটকির চাহিদা সবচেয়ে বেশি উত্তরবঙ্গে।

পাশাপাশি এখান থেকে কিছু পরিমাণ শুঁটকি যায় স্থানীয় মৎস্য খামারগুলোতে।

মাছের খাবার হিসেবেও এই শুঁটকির চাহিদা রয়েছে। প্রতি মৌসুমে প্রায় ৫০-৫৫ টন শুকটি প্রস্তুত করা হয় এখানে। তবে এখানে শুঁটকি তৈরিতে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। একদিকে যেমন ব্যাংকের ঋণ পাওয়াটা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে, অপরদিকে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের যথার্থ সহযোগিতা না পাওয়াটাও অন্যতম কারণ।

এখানে অনেক কর্মচারী কর্মরত রয়েছেন। তাদের সময়মতো বেতন পরিশোধ করা হয়। তবে অর্থনৈতিক সংকটের কারণে ব্যবসার পরিধি বৃদ্ধি করার পরিকল্পনা থাকলেও সেটা করা সম্ভব হচ্ছে না।

তিনি আরও বলেন, সাতক্ষীরায় শুঁটকি তৈরির জন্য উপযুক্ত একটি স্থান।কারণ এখানে মিঠা পানির মাছগুলো তুলনামূল ক অল্প দামে কেনা যায়।

পরিকল্পনা অনুযায়ী এই শিল্পকে যদি ধরে রাখা যায় সেক্ষে ত্রে সমগ্র দেশের কাছে সাতক্ষীরার শুঁটকি জনপ্রিয়তা অর্জ ন করবে।

এজন্য সরকারি সহায়তার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রশিক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে।

এসব বিষয় নিয়ে সংশ্লিষ্ট মৎস্য অধিদপ্তরে কথা বলা হয়ে ছে। তারা প্রতিশ্রুত দিয়েছেন তবে এখনও সহায়তাসহ প্রশিক্ষণের কার্যক্রম শুরু করেনি।

সাতক্ষীরা ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করর্পোরেশনের (বিসিক) উপ-ব্যবস্থাপক গোলাম সাকলাইন বলেন, বৈদেশিক অর্থ উপার্জ নের ক্ষেত্রে সাতক্ষীরার মৎস্য খাতের সুনাম রয়েছে দেশ ব্যাপী।

সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে সাতক্ষীরার অবস্থান হওয়ায় এখানে চিংড়ি মাছের পাশাপাশি মিঠা পানির সাদা মাছের খ্যাতি কো নো অংশে কম নয়।

বর্তমান সময়ে সাতক্ষীরার বিনেরপোতায় মিঠা পানির শুঁটকি স্থান করে নিয়েছে রাজধানী ঢাকাসহ উত্তরবঙ্গের অনেক গু লো অঞ্চল।

সাতক্ষীরার ঘেরের মিঠা পানির সাদা মাছগুলোকে যারা শুঁটকিতে রূপান্তর করছে নিঃসন্দেহে সাতক্ষীরার অর্থনী তিতে তাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

এই শিল্পকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে বিসিকের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করা হবে।

তাছাড়া সাতক্ষী রার এই শুঁটকি সমগ্র দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে জানান এই কর্মকর্তা।

সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ আনিছুর রহমান বলেন, সাতক্ষীরায় তৈরি মিঠাপানির শুঁটকি বাজারে নতুন করে ক্রেতা তৈরি করেছে।

অপরদিকে, এই কাজের সঙ্গে জড়িত উদ্যোক্তারা ইতিমধ্যে বেশ সুনাম অর্জন করেছেন। সাতক্ষীরা উপকূলীয় জেলার মাছের মধ্যে অন্যতম হলো ভেটকি।

এই ভেটকি মাছ চাষের ক্ষেত্রে শুঁটকির ব্যাপক প্রয়োজন
রয়েছে। কারণ ভেটকি মাছের খাদ্য হিসেবে অনেক ক্ষেত্রে শুঁটকি ব্যবহার করা হয়।

সেক্ষেত্রে সাতক্ষীরায় তৈরি বিভিন্ন মাছের শুঁটকি এখানকার
মৎস্য চাষিদের চাহিদা মেটাতে সক্ষম হচ্ছে।

এই শিল্পকে এগিয়ে নিতে পারলে সেটা সাতক্ষীরাসহ দেশের অর্থনীতিতে অনেক বড় একটি অবদান থাকবে।

তিনি আরও বলেন, সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তার সঙ্গে কথা বলে তাদে র সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে।

একই সঙ্গে সেখানে কর্মরত শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষাসহ সার্বিক বিষয়ে প্রশিক্ষণের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে।

তাদেরকে সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে কোনো প্রকার সহযোগিতার সুযোগ রয়েছে কিনা সেই বিষয়টিও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। চিঠির উত্তর পেলে সেটাকে বাস্তবে রূপান্তর করা হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *